কেমন হবে পৌরসভা নির্বাচন?

আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মেয়াদ শেষ হলে বাকি পৌরসভাগুলোতেও নির্বাচন। ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনে পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে।
আমাদের রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্ক প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। এককেন্দ্রিক দেশ বলে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ঢাকাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। বাংলাদেশ যদি আজ কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত হতো, তাহলে ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতি থাকত না। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা অধ্যুষিত উন্নয়নশীল দেশ এক কেন্দ্র থেকে শাসন করা ঠিক নয়। এতে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। কিন্তু আমাদের বড় দুটি রাজনৈতিক দল (যারা পালা করে ক্ষমতায় যায়) ও কেন্দ্রীয় প্রশাসন তাদের সুবিধাবাদী স্বার্থে বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক প্রশাসন টিকিয়ে রেখেছে। এই পটভূমিতে পৌরসভার নির্বাচন অনেকটা নিয়মরক্ষার ঘটনা। পৌরসভার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সুষ্ঠু প্রশাসন ও উন্নয়নের যে সম্ভাবনা ছিল, তা কেন্দ্রের ভুল নীতির জন্য যথাযথ বাস্তবায়িত হয় না। দলীয় ও নির্দলীয় কিছু মানুষ উপকৃত হয়। স্থানীয়ভাবে কিছু উন্নয়ন হয়।
প্রায় সে রকম অবস্থা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। কয়েক দিন আগে উত্তরের মেয়র আনিসুল হক এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে তঁার কোনো ক্ষমতা নেই। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া ও কিছু ফুলের গাছ লাগানো ছাড়া। কিন্তু এই ক্ষমতাহীন মেয়রের নির্বাচন নিয়ে সরকারের উৎসাহের কমতি নেই। কারণ, পুরো ব্যাপারটাই নিয়মরক্ষার জন্য। দুই বড় দল স্থানীয় সরকারের এই ঘাটতিগুলো দূর করতে আগ্রহী নয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে। কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষমতার দাপট দেখানোর বহু সুযোগ রয়েছে।
এবারের পৌরসভা নির্বাচন গতানুগতিক নির্বাচন হবে না। সরকার সম্প্রতি নতুন আইন করে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রধান (মেয়র, চেয়ারপারসন) দলীয় ভিত্তিতে ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত করার বিধান রেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরের নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকার দাবি করেছে, ‘তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রচর্চার জন্য এটা উত্তম ব্যবস্থা।’ হয়তো তা-ই। কিন্তু সরকার এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনো আলোচনা ছাড়াই। স্থানীয় সরকারের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা সরকার প্রয়োজন মনে করেনি। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নতুন আইন এক মাসের মধ্যে কয়েকবার পরিবর্তন করলেও তা কাদের সঙ্গে আলোচনা করে করেছে, তা জানা যায়নি।

>স্থানীয় সরকারের কয়েকটি স্তরে নির্বাচিত পরিষদ কখনো স্থানীয় সাংসদ, কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা, কখনো প্রশাসন নিযুক্ত আমলার কারণে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। অতীতে তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি

নতুন আইনে বলা হয়েছে, পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী হবেন দলের মনোনয়নে, নির্বাচন করবেন দলের প্রতীকে। বাকি কাউন্সিলররা নির্দলীয়, স্বতন্ত্র, বিভিন্ন প্রতীকে। অর্থাৎ পৌরসভার পরিষদে মেয়র হবেন একটি দলের নেতা আর তাঁর কাউন্সিলররা হবেন সব নির্দলীয়। এ রকম জগাখিচুড়ি নির্বাচিত পরিষদ এর আগে দেখা যায়নি। সরকার একবার চিন্তা করেছিল পৌরসভার সবাই দলের মনোনয়নে ও প্রতীকে নির্বাচন করবেন। কিন্তু নানা সমালোচনা ও কিছু বাস্তব কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শুধু মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক রেখেছে। অনেকের কাছে প্রশ্ন জাগতে পারে, সরকার কেন এটা করেছে? এর উত্তর সরকারই দিতে পারবে। তবে আমাদের ধারণা হচ্ছে, সরকার পৌরসভাগুলো দলের কবজায় রাখতে চায়। স্থানীয় সরকারের সব স্তরে ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে’ নির্বাচন হয়। কাজেই পৌরসভায়ও মেয়রই হবেন সর্বেসর্বা, সবচেয়ে ÿক্ষমতাবান। নির্দলীয় কাউন্সিলররা ততটুকুই ক্ষমতা ভোগ করবেন, মেয়র মহোদয় দয়াপরবশ হয়ে যতটুকু ক্ষমতা দেবেন। তাঁদের কোনো কণ্ঠ থাকবে না। তাই সরকার কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহী হয়নি। কার্যত মেয়রই পৌরসভা চালাবেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের দিকে তাকান, একই চিত্র দেখবেন।
স্থানীয় সরকারের সব স্তরে ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির’ নির্বাচন বহাল রয়েছে। অর্থাৎ সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচন। অথচ কেন্দ্রে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার। প্রধানমন্ত্রীকে সাংসদদের ভোটেই নির্বাচিত হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে চাইলে পরিবর্তন করা যায়। একজন মেয়রকে পাঁচ বছরের আগে পরিবর্তন করা যায় না। নির্বাচন পদ্ধতিতে এই স্ববিরোধিতা কেন? এর কোনো জবাব নেই। ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি’ যদি এত ভালো হয়, তাহলে কেন্দ্রেও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি চালু করলেই হয়। বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতি কি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির চেয়ে গুণগতভাবে ভিন্ন কিছু?
আমাদের স্থানীয় সরকারের কয়েকটি স্তর যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তাঁরা নির্বাচিত হয়েও যেন নির্বাচিত নন। বাংলাদেশে একমাত্র ‘সাংসদকেই’ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মনে করা হয়। সরকারও তাঁদের বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করেন না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন মেয়র এখনো তাঁদের স্ট্যাটাস পাননি। অথচ তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।
স্থানীয় সরকারের কয়েকটি স্তরে নির্বাচিত পরিষদ কখনো স্থানীয় সাংসদ, কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা, কখনো প্রশাসন নিযুক্ত আমলার কারণে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। অতীতে তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। সরকার সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। নতুন আইনে সেই সমস্যা আরও বেড়ে যাবে। দলীয় মেয়র তো নির্বাচিত কাউন্সিলরদের কোনো কথা শুনবেন বলে মনে হয় না। দলীয় নেতৃত্বের দোহাই দেবেন। বেচারা নির্দলীয় কাউন্সিলরদের তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি! তবে দলীয় মেয়র হওয়ায় একটা উপকার হলেও হতে পারে। পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা এসব প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদের ছড়ি ঘোরানো কিছুটা কমতে পারে। কারণ, স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত ব্যক্তিরাও দলের নেতা। ‘যুদ্ধটা’ সেয়ানে সেয়ানে হবে।
বিএনপি দেশের অন্যতম বড় দল। দলীয় ভিত্তিতে পৌরসভা নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা বিএনপির। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি হবে? বিএনপি অভিযোগ করেছে, ‘সারা দেশে তাদের হাজার হাজার নেতা ও কর্মীকে নানা অভিযোগে সরকার গ্রেপ্তার করেছে। অনেকে মামলার ভয়ে ফেরারি। অনেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঘরছাড়া।’ এঁদের মধ্যে অনেকেই পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতেন। অনেক জায়গায় বেশ শক্তিশালী প্রার্থীও বিএনপির রয়েছে। কিন্তু তাঁরা তো নির্বাচন করতে পারছেন না। বিএনপিকে কি তাহলে মামলাহীন, অভিযোগহীন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে হবে? এমনও হতে পারে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি বা তাদের জোটের জনপ্রিয় প্রার্থীদের ‘পেট্রলবোমা সন্ত্রাসের’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করে রাখা হবে। আজকাল বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় উসকানিদাতা, পরামর্শদাতা, অর্থদাতা ইত্যাদি অভিযোগে মামলা বা গ্রেপ্তার একেবারে ডাল-ভাত হয়ে গেছে। পেট্রলবোমা সন্ত্রাস সরকারকে একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচন কোন মডেলের হবে? প্রশ্নবিদ্ধ ও ছকে সাজানো নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশনের কোনো বিলম্ব হয় না। তবু আমরা আশাবাদী যে নির্বাচন কমিশন এ রকম কাজ আর করবে না। তবে কোনো দল, ভোটার বা স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি সদ্য অতীতের কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এ রকম আশঙ্কা করেন, তাঁদের কী বলব?
পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হচ্ছে। এখন রাজনীতিতে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তা হয়তো অনেকটাই দূর হবে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা কোথায় পাব? কার কাছে পাব?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর : মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।