প্রশ্নটি রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার—সবার প্রতি। অন্তত পরিবার কি খোঁজ নেয় তাদের যুবা বয়সের ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? চেম্বারে ছেলেকে নিয়ে বাবা এসেছেন। অভিযোগ, সামনে এসএসসি পরীক্ষা অথচ ছেলে এ সময়ে স্কুল বদলাতে চাইছে। কারণ হিসেবে জানা গেল, তার কয়েকজন বন্ধু অনেক দিন যাবৎ তাকে টিটকারি, তিরস্কার, অপমান করে যাচ্ছে। তাকে বন্ধুরা ‘সাপ’ ও ‘বেইমান’ বলে এবং তাকে দেখলেই সাপের মতন ‘হিস হিস’ শব্দ করতে থাকে। ফেসবুকে তাদের একটি গ্রুপ চ্যাট আছে। কিছুদিন আগে সেই গ্রুপের প্রোফাইল পিকচারে একটি সাপের ছবির মাথায় তার ছবি দিয়ে তারা পোস্ট দেয়।
ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? সে বলে, সহপাঠীরা আরও খেপে যাবে—এ ভয়ে কাউকে জানায়নি। বাবার কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা কী করেছেন? তিনি বলেন, ‘আমরা তো কিছু জানতামই না। পরীক্ষার আগে স্কুল পরিবর্তনের গোঁ ধরায় জানতে পারি।’
আমরা পরিবারের সদস্যরা অনেক পরে জানতে পারি, তারা বিপদগ্রস্ত, ব্ল্যাকমেলের শিকার বা হেনস্তা-লাঞ্ছনার শিকার। অথবা জানতে পারি উল্টোটাও, আমার সন্তান মাদকাসক্ত, ধর্ষণে লিপ্ত, হত্যা-খুনের সঙ্গে জড়িত বা অন্য কোনো অনৈতিক-অবৈধ কাজে লিপ্ত।
প্রতিবছর ১০ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘পরিবর্তিত বিশ্বে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য’। অন্তত এ দিবসের প্রতিপাদ্যের কারণে হলেও খোঁজ নিতে হবে আমাদের তরুণেরা কেমন আছে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৪ থেকে ২৮ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা হচ্ছে তরুণ।
দিন দিন এ তরুণদের মাঝে বাড়ছে অধৈর্য,অস্থিরতা, সহিংসতা, আত্মহত্যার ঝোঁক, মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ। যাদের মানসিক রোগ হয়, তাদের ৫০ শতাংশের ওই রোগের প্রথম লক্ষণ ১৪ বছরের মধ্যেই দেখা দেয়। আবার লক্ষণ দেখা দেওয়া ও চিকিৎসা নেওয়ার মধ্যে ফারাক থাকে প্রায় পাঁচ বছর। আমাদের এই অজ্ঞতা ও অসচেতনতা কাটিয়ে উঠতে হবে, কেননা জীবনকে সুন্দর, সার্থক, সুখী করতে হলে শৈশব থেকেই ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে।
কিছু পরিসংখ্যান
কৈশোর-তারুণ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। প্রতি ১০ মিনিটে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও একজন কিশোরী সহিংসতার কারণে মারা যায় (ইউনাইটেড ন্যাশনস চিলড্রেন ফান্ড); ৮৩ শতাংশ তরুণ মনে করে, বুলিং বা খ্যাপানো তাদের আত্মমর্যাদার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে (ডিসথেলেবল ডট অরগ); ট্রান্সজেন্ডার তরুণদের ৫১ শতাংশ আত্মহত্যার চিন্তা করে, ৩০ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করে (সেন্টার ফর ট্রান্স ইউথ হেলথ অ্যাট চিলড্রেন হসপিটাল, লস অ্যাঞ্জেলেস) এবং ২০ শতাংশ তরুণ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভোগে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।
সাইবার বুলিং
ওপরে যে স্কুল বদলানোর ছেলের কথা বললাম, তার ওপর যেটা হয়েছে, সেটা সাইবার বুলিংয়ের একটি উদাহরণ। ই-মেইলে, টেক্সটে বা অনলাইন পোস্টে বিব্রতকর বা হুমকিজনক ছবি বা তথ্য দেওয়া; এমন মন্তব্য ও পোস্ট, যা ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বা তাকে আহত করে। অথবা আক্রমণাত্মক বা বিদ্বেষমূলক যেকোনো আচরণকে সাইবার বুলিং বলা হয়। শতকরা ২০ জন নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। এ রকম বুলিংয়ের জন্য হাজার হাজার ছেলেমেয়ে শুধু মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে না, তারা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় পড়ছে, মানসিক রোগে ভুগছে, পড়াশোনা-ক্যারিয়ার নষ্ট হচ্ছে, সর্বোপরি অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে।
নির্যাতন
পরিবার ও অন্যত্র তরুণেরা শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। এ ছাড়া অবহেলা, বঞ্চিত হওয়ার বোধ তো রয়েছেই।
সহিংসতা ও মাদকাসক্তি
ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই প্রভৃতি মারাত্মক অপরাধমূলক কাজে অনেক তরুণ জড়িয়ে যাচ্ছে। গ্যাং কালচার, ডিজে পার্টিসহ নানান রকম নিত্যনতুন চর্চা ও প্রবণতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ছে আমাদের সন্তানেরা।
আত্মহত্যা
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় আট লাখ লোক আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে তরুণদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। ৭৮ শতাংশ আত্মহত্যা ঘটে আমাদের মতন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। আত্মহত্যার আচরণের মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যার চিন্তা বা পরিকল্পনা, আত্মহত্যার চেষ্টা ও আত্মহত্যা।
যেভাবে বুঝবেন কেউ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে কি না
মরতে চাওয়া, নিজকে হত্যা করতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ; আশাহীন ও শূন্যতাবোধ, বেঁচে থাকার যুক্তি নেই মনে করা; আত্মহত্যার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা; জীবনের ঘেরাটোপে আটকে গেছি ও এর কোনো সমাধান নেই এমন মনোভাব; অসহ্য যন্ত্রণা (শারীরিক বা মানসিক); অন্যদের বোঝা হয়ে আছি মনে করা; পরিবার, বন্ধু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া; ক্রোধ দেখানো, প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা; আবেগ বা মন-মেজাজের অস্বাভাবিক ওঠানামা (তীব্র অশান্তি থেকে হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া বা সুখী হয়ে ওঠা—আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললে অনেক রোগী ‘রিলিফ’ ফিল করে ও সব যন্ত্রণার অবসান হতে যাচ্ছে ভেবে শান্ত হয়, এমনকি সুখী ভাব দেখা দেয়)।
মনে রাখতে হবে, যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তাদের পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করার ঝুঁকি সাধারণের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। আত্মহত্যার কথা বলা ও চেষ্টাকে তাই খাটো করে দেখার উপায় নেই এবং এরা প্রকৃত আত্মহত্যা করবে না—এ রকম ভাবা সঠিক না।
নিজকে ক্ষত/আহত করা (সেল্ফ হার্ম)
আত্মহত্যার ইচ্ছে নেই, তবুও নিজ ইচ্ছায় নিজকে আহত করা কিছু আবেগতাড়িত তরুণ-তরুণীর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। পরিবার, দাম্পত্য জীবন বা প্রেমের সম্পর্কে সামান্য মানসিক আঘাত পেলে, আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলে বা অপরকে ম্যানপুলেট করতে তারা হাত কেটে ফেলে, ঘুমের ওষুধ খায়, ক্ষতিকর কিছু গলাধঃকরণ করে, শরীরের অংশবিশেষ পুড়িয়ে ফেলে ইত্যাদি।
যা করণীয়
সামান্য কিছু ভালো কাজই অনেকের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। আমেরিকায় নিউইয়র্কে ‘মেন্টাল হেলথ এডুকেশন ইন স্কুলস ল’ নামে একটি আইন পাস করা হয়েছে। এই আইনে নিউইয়র্কের কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দেশেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নানামুখী প্রচার ও প্রোগ্রাম রয়েছে। যেমন: হাত ধোয়া, দাঁত মাজা, ভালো পুষ্টি, ব্যায়াম। একই রকম প্রচার ও প্রোগ্রাম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য থাকবে না কেন? ঢাকা মেডিকেলে ছাত্রছাত্রীদের ‘শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য’ নিয়ে একটি ক্লাসের পর এক ছাত্রী জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, টিভিতে সন্তানকে ওরস্যালাইন খাওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আপনার ক্লাস শুনে মনে হচ্ছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে এ রকম বিজ্ঞাপন দেওয়া আরও জরুরি।’
উন্নত দেশগুলোতে স্কুল-কলেজ থেকেই ‘সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নিং’ (এসইএল) শেখানো হয়। এতে থাকে আত্মসচেতন হওয়ার শিক্ষা; নিজেকে সামলানোর কৌশল; সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি; সম্পর্ক ও যোগাযোগ-দক্ষতা; দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা। এ ছাড়া তরুণদের শেখাতে হবে যেকোনো চাপ, দুর্যোগ, বিপর্যয়ের পর কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয় ও দুরূহ স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে সহযোগিতাপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক; সমস্যা সমাধানে ভালো দক্ষতা; কখন, কোথায়, কার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে হবে তা জানা।
সর্বশেষে বলব, তরুণদের সঙ্গে যেন পরিবারের থাকে অকপট, খোলামেলা, সৎ যোগাযোগ রাখা হয়। তাদের ‘ক্ষমতায়িত’ করতে হবে যেন নিজ দায়িত্বে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে এবং পরিবারে যেন একটি ‘প্রযুক্তিমুক্ত’ (টেক-ফ্রি) সময় থাকে, তেমন সময় পরিবারের সবাই একত্র হয়ে নিজেদের মতন করে সময় কাটাতে পারেন।
ডা. তাজুল ইসলাম: প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।
drtazul84@gmail.com