যেসব ভোটার মাখোঁকে পছন্দ করেন না, তাঁদের দিকেও এখন মনোযোগ দিতে হবে
যেসব ভোটার মাখোঁকে পছন্দ করেন না, তাঁদের দিকেও এখন মনোযোগ দিতে হবে

মতামত

কেন ফ্রান্সের এত বেশি মানুষ মাখোঁকে ঘৃণা করেন

ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র নয়। আমার মতো আরও অনেক উদারপন্থী ফ্রান্সের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের উদ্বেগের বিষয় ছিল, ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে যে কারণে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন, সেই একই কারণে এবার ফ্রান্সের নির্বাচনে মেরিন লঁ পেন জয়ী হবেন কি না। কেননা, অতি ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী প্রার্থীর উচ্চকিত স্বরের কাছে অপেক্ষাকৃত উদার প্রার্থীর কণ্ঠস্বর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল।

সৌভাগ্যের বিষয়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমানুয়েল মাখোঁকে পছন্দ করেন না, এমন অনেকে শেষ ধাপের নির্বাচনে লঁ পেনকে ছুড়ে ফেলতে তাঁকেই ভোট দিয়েছেন। অনেক ভোটার বলেছেন, যদি কলেরা ও প্লেগের মধ্যে কোনোটাকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে প্রথমটা হবে পরেরটার চেয়ে ভালো। মাখোঁও তাঁর বিজয় ভাষণে বিষয়টাকে স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আমি জানি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আমার চিন্তাকে পছন্দ করেন না, বরং কট্টর ডানপন্থী লঁ পেনকে ঠেকাতে ভোট দিয়েছেন। যাঁরা আমাকে পছন্দ করেন কিংবা লঁ পেনকে ঠেকাতে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতিই কৃতজ্ঞতা।’

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, লঁ পেনকে বেছে নিয়েছেন ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার। ফ্রান্সে তিনি চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা, জাতিবাদী ও অনুদারপন্থী রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করেন। এটা সত্যিই উদ্বেগের ঘটনা। কেন ফ্রান্সের এত বেশি মানুষ মাখোঁকে ঘৃণা করেন?

ফ্রান্সের এত বেশিসংখ্যক ভোটার কেন মাখোঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন—এ প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে কেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা গ্রহণ করতে পারেননি। হিলারি ক্লিনটন কিংবা ইমানুয়েল মাখোঁর মতো প্রার্থীরা দাম্ভিক ও নির্লিপ্ত ধরনের হন। নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্পের সমর্থকদের উদ্দেশে হিলারি তাঁর কুখ্যাত ‘অনুশোচনার ঝুড়ি’ মন্তব্যটি ছুড়ে দিয়েছিলেন। স্বল্পশিক্ষিত মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করার এটা একটা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি।

রাজনৈতিক দলগুলোতে মানুষ একত্র হয় শ্রেণিভিত্তিক অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে। বামপন্থীরা ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাঁরা মূলত শিল্পকারখানার শ্রমজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডানপন্থীরা ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য কথা বলেন। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর থাকে, কেননা এই দলগুলো শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। তাই এটা পরিষ্কার যে কেন ভোটাররা উদার গণতন্ত্রীদের পক্ষে দাঁড়ান। বেশির ভাগ ভোটার মনে করেন, উদার গণতন্ত্রী দলগুলোতে তাঁদের অংশীদারত্ব রয়েছে।

শ্রমজীবী শ্রেণির অনেক ভোটারই বামপন্থী ও ডানপন্থী দুই শিবিরের কাছ থেকেই প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করেন। বামপন্থীরা তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব আর করেন না এবং তাঁদের সামাজিক আচরণকে অবজ্ঞা করেন। অন্যদিকে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় গেলে তাঁদের প্রতি আর মনোযোগ দেন না। ট্রাম্প ও মাখোঁও দুজনই এই রাজনৈতিক শূন্যতাকে ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির ঘাড়ে চেপে বসে সেটাকে জনতুষ্টিবাদী প্রথায় পরিণত করেছেন। অন্যদিকে মাখোঁও ফ্রান্সের মধ্য বাম ও মধ্য ডান দলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

১৯৮০-এর দশক থেকে এই ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। সে সময় বামপন্থী দলগুলো শ্রেণি ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে শুরু করে এবং বর্ণবাদবিরোধিতা, লিঙ্গীয় মুক্তি ও যৌনতার স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করে। শিল্পায়নের বিকাশ থমকে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন দুর্বল হতে শুরু করে। এর ফলে সমাজতন্ত্রী ও সামাজিক গণতন্ত্রী দলগুলোর সঙ্গে শ্রমজীবীরা সংযোগ হারাতে শুরু করেন। এর বদলে বামপন্থীরা শিক্ষিত ও শহুরে সচ্ছল গোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বামপন্থী সমর্থক গোষ্ঠীর অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চা পছন্দ করেন না। বর্ণবাদের মতো সামাজিক কুসংস্কারেরও তাঁরা বিরোধিতা করেন।

অভিজাত বামপন্থীরা যে বড় ভুলটা করেন, সেটা হলো তাঁরা মনে করেন, শহর ও গ্রামের শ্রমজীবী মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁদের ‘প্রগতিশীল’ ভাবনাকে ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে অনেক মানুষ, যাঁরা নিজেদের শ্রমজীবী হিসেবে মনে করেন, তাঁরা বামপন্থীদের চোখে রক্ষণশীল। ধর্ম গরিবদের মধ্যে আরও গেঁড়ে বসেছে। অভিবাসন প্রায়শই তাঁদের কাছে চাকরি হারানোর দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখা দেয়। সমকামিতার অধিকার তাঁদের কাছে মাথাব্যথার বিষয় নয়। আর এগুলো এখন শুধু শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের জন্য সত্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এখন অনেক লাতিন বংশোদ্ভূত, এমনকি কালোরাও রিপাবলিকান পার্টিকে ভোট দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার ও যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যানের আমলে ট্রেড ইউনিয়ন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় থেকেই শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতি থেকে বামেরা সরে আসেন। তাঁরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। মুক্ত বাজার অর্থনীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য একটা মধ্যপন্থী সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি কখনোই পশ্চিমা নেতাদের জন্য জরুরি হয়ে ওঠেনি। এমনকি যুক্তরাজ্যে টনি ব্লেয়ারের প্রধানমন্ত্রিত্বে লেবার পার্টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিল ক্লিনটনও নয়া-উদারবাদী নীতি বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে রক্ষণশীল গ্রামীণ ভোটার ও শহুরে শ্রমজীবী শ্রেণি যদি বামপন্থী পার্টিগুলো থেকে নিজেদের ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকে, তাহলে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণির সমর্থক ডানপন্থী দলগুলোর প্রতি তারা মনোযোগী হবে, এমনটা নয়। বহু বছর ধরে রিপাবলিকান অভিজাতেরা, শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ‘খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর, তারা যথারীতি ব্যবসায়ী শ্রেণির দিকেই নিজেদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখে।

শ্রমজীবী শ্রেণির অনেক ভোটারই বামপন্থী ও ডানপন্থী দুই শিবিরের কাছ থেকেই প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করেন। বামপন্থীরা তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব আর করেন না এবং তাঁদের সামাজিক আচরণকে অবজ্ঞা করেন। অন্যদিকে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় গেলে তাঁদের প্রতি আর মনোযোগ দেন না। ট্রাম্প ও মাখোঁও দুজনই এই রাজনৈতিক শূন্যতাকে ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির ঘাড়ে চেপে বসে সেটাকে জনতুষ্টিবাদী প্রথায় পরিণত করেছেন। অন্যদিকে মাখোঁও ফ্রান্সের মধ্য বাম ও মধ্য ডান দলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দুজনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তাঁরা দেশের সব সমস্যা একাই সমাধান করে ফেলবেন। তাঁদের মনোভাব এমন যেন তাঁরা আজকের দিনের ‘রাজা’।

কিন্তু মাখোঁর ক্ষেত্রে একটি সমস্যা রয়ে গেছে। লঁ পেন ও ট্রাম্প প্যারিস ও নিউইয়র্কে বড় হয়েছেন। মাখোঁর তুলনায় তাঁদের সম্পদ ও সচ্ছলতা ছিল অনেক বেশি। তাঁরা দুজন ভালো করেই বোঝেন শিক্ষিত অভিজাতদের প্রতি জনগণের অসন্তোষ ও ঘৃণা রয়েছে। মাখোঁও উঠে এসেছেন ফ্রান্সের প্রান্তীয় মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তিনি পুরোনো বামপন্থী ও পুরোনো ডানপন্থী দলগুলোর মতাদর্শের ওপর ভর করে ধীরে ধীরে ওপরের শ্রেণিতে উঠেছেন। শেষে নিজেই সেই দলগুলোকে ধ্বংস করতে সহায়তা করেছেন।

সে কারণেই মাখোঁকে শহরগুলোর বয়স্ক ও উচ্চশিক্ষিত ভোটারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফ্রান্সের বয়স্ক শ্রমজীবী ভোটাররা হয় অতি বামপন্থী অথবা অতি ডানপন্থী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। গ্রামীণ ভোটাররা লঁ পেনকে বেশি ভোট দিয়েছেন। তরুণ ভোটাররা অতি বামপন্থী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন অথবা ভোটই দেননি। আমরা এখন দুশ্চিন্তা থেকে সাময়িক একটা মুক্তি পাচ্ছি। ফ্রান্সের বেশির ভাগ ভোটার একটা বিপর্যয় থেকে দেশটিকে রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু যেসব ভোটার মাখোঁকে পছন্দ করেন না, তাঁদের দিকেও এখন মনোযোগ দিতে হবে। সর্বোপরি, উদারপন্থীরা শুধু শহুরে অভিজাত সম্প্রদায়ের ভোটের ওপর নির্ভর করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটরা ফ্রান্স থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
ইয়ান বুরুমা দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল’, ‘ফ্রম উইনস্টন অ্যান্ড এফডিআর টু ট্রাম্প অ্যান্ড ব্রেক্সিট’ বইয়ের লেখক