তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দ্বৈরথের মধ্যে যে ব্যাপারটি আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে, তা হলো ভারতে কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যকার সম্পর্কের রূপটি এখন কোন পর্যায়ে। যখন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিপিআরএফ) পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কার্যালয়কে রক্ষা করল, তখন কেন্দ্র মূলত এই বার্তা দিল যে তারাই সর্বেসর্বা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের। আর সেটা বাস্তবায়ন করার বাহিনীও তাদের আছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বললেন, ‘আমরাও সরকার’, তখন তিনি কেন্দ্রের প্রতি এই মর্মে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন যে রাজ্যই নিজের ব্যাপারে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। ভারত ফেডারেল রাষ্ট্র। এই দেশটির সংবিধানে যা লেখা আছে, তার আলোকে রাজ্যগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন আদেশে বলেছেন, কেন্দ্র রাজ্যের নিজস্ব ব্যাপারে নাক গলাতে পারে না। অর্থাৎ, রাজ্যের নিজস্ব ব্যাপারে তার মতামতের তোয়াক্কা না করে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না।
এই ব্যাপারটাও সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যের দৃেঢ়াক্তি। বিভিন্ন রাজ্যের বেলায় আগেও এমনটা হয়েছে। কেরালায় বিভিন্ন সময় কমিউনিস্টরা শাসন করেছে, এই রাজ্যটিকেও কেন্দ্র সময়-সময় বিরক্ত করেছে। এমনকি কেন্দ্র ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করেছিল।
স্বাধীনতার পরপরই ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কংগ্রেসশাসিত কেন্দ্রের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন। কেন্দ্র প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু নাম্বুদিরিপাদ তর্ক করেছিলেন, এটা ব্রিটিশ আইন, যা গণতান্ত্রিক দেশের কাঠামোর সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে তিনি এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে তিনি একাই এই আইনের বিরোধিতা করেছিলেন।
ওই বৈঠকে পশ্চিম বাংলার মুখমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়ও উপস্থিত ছিলেন। ইএমএসের কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে তিরস্কার করে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে আপনিই একমাত্র দেশপ্রেমিক।’ কিন্তু ইএমএস তাঁর অবস্থান থেকে বিচ্যুত না হয়ে স্রেফ বলেন, তিনি এই ব্যাপারে বিধান রায়ের সঙ্গে যোগ দিতে চান না। কিন্তু তিনি চান, তাঁর এই ‘না’ যেন নথিভুক্ত করা হয়। এরপর যখন এই বিষয়টি তাঁর পার্টিতে এল, তখন দল তাঁকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দেয়।
তবে ইএমএস যা বলেছিলেন, তার প্রমাণ পেতে বেশি সময় লাগেনি। কিছুদিন পরই কেন্দ্র রেল ধর্মঘটের সম্মুখীন হয়। কেরালা সরকার ধর্মঘটকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। কেরালার অনুপ্রেরণা লাভকারী কর্মীরা হুমকি দিল, তারা রাজ্যের কেন্দ্রীয় দপ্তরে আগুন লাগিয়ে দেবে। এরপর নয়াদিল্লি কেন্দ্রীয় পুলিশ মোতায়েন করে নিজের সম্পদ রক্ষা করে। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি ছিল। কারণ, রাজ্য পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ সুরক্ষায় কিছু করবে না। সৌভাগ্যবশত সেদিন শ্রমিকেরা শক্তিপরীক্ষার ঘোষণা দেয়নি। কারণ, সরকার শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়।
দেখা গেল, রেল শ্রমিকদের ধর্মঘটের পরিণতি হিসেবে আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠিত হলো—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ, যার পৌরোহিত্য করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর উদ্দেশ্য ছিল, রাজ্যগুলো তাদের মধ্যে আলোচনা করে ভিন্নতা দূর করতে পারে, অর্থাৎ তা সংসদে আসার আগেই। কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোতে যত দিন কংগ্রেস শাসন করেছে, তত দিন এই কাউন্সিলগুলো টিকে ছিল। কিন্তু রাজ্যগুলোতে অন্য দল ক্ষমতায় আসতে শুরু করলে এই বন্দোবস্ত আর কাজ করেনি। এরপর বারোয়ারি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জনতা পার্টি যখন ক্ষমতায় এল, তখন এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলো, সময়টা ছিল ১৯৭৭ সাল। বলা হলো, ক্ষমতায় যে দল আছে তারাই যেহেতু সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করবে, তাই এই আঞ্চলিক কাউন্সিলের প্রয়োজন নেই।
তা ছাড়া কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক তেমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না, বিশেষ করে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকে। যেসব রাজ্যে অন্য রাজনৈতিক দল শাসন করছে, সেখানেও তারা নিজেদের আদর্শ জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে। বিজেপির মাঠকর্মীর দায়িত্ব পালন করে আরএসএস, যাদের ব্যাপারে বিরোধীদের অসন্তুষ্টি আছে। এখন বিজেপি যদি নিজের আদর্শের আলোকে নীতি প্রণয়ন করতে থাকে, তাহলে ভারতের ফেডারেল ঐক্য হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে দেশের একতা অক্ষুণ্ন থাকে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের পাঁচটি রাজ্য, অর্থাৎ উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, পাঞ্জাব, মণিপুর ও গোয়ায় যে রাজ্যসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে বিজেপি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে উন্মুখ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ ক্ষমতা বাড়াতে যেকোনো কিছু করতে পারেন। নির্বাচনের আগে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, বিজেপির মনে কী আছে।
ওদিকে সমাজবাদী পার্টির (এসপি) গৃহবিবাদের কারণে বিজেপি লাভবান হয়েছে। যদিও মুলায়ম সিং বলেছেন, তিনি দলনেতা হিসেবে এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, যাতে দলীয় ঐক্য বজায় থাকে। কিন্তু তাঁর ভাই শিভপাল যাদব সব নষ্ট করছেন। সিংহভাগ এমএলএ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সঙ্গেই আছেন, ফলে তাঁর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রশ্নও ওঠে না।
হয়তো এটা শুধু চায়ের কাপের ঝড়, কিন্তু তা সমাজবাদী পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। ভোটারদের কাছে অখিলেশ যাদবের সাফসুতরো ভাবমূর্তি আছে, যিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে সরকার চালাতে চাইছেন। তিনি যেসব কল্যাণকামী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটাও তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করবে। ফলে কংগ্রেস যে বিজেপি ঠেকাতে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে নির্বাচনপূর্ব ঐক্য গড়তে চাইছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
পাঞ্জাবের পরিস্থিতি এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। আকালি-বিজেপি জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। কারণ, আম আদমি পার্টিতে পাঞ্জাবি মুখ নেই, যাঁকে তারা দেখাতে পারে, তিনি পাঞ্জাবেরই মানুষ। ওদিকে উত্তরাখন্ডে বিজেপি যেভাবে আদালতের হস্তক্ষেপের আগে রাওয়াত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করল, তাতে কংগ্রেস হয়তো সেখানে উতরে যাবে। মণিপুর ও গোয়ায় স্থানীয় শক্তিগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কংগ্রেসের ব্যর্থতায় বিজেপি যখন একমাত্র বিকল্প হয়ে ওঠে, তখন তার উত্থান তো কেউ ঠেকাতে পারে না।
নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, বিজেপিশাসিত কেন্দ্র রাজ্যের পরিস্থিতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে তারা সবচেয়ে দুর্বল। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে প্রতিদিনই খুঁটিনাটি বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, এতে মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।