ইতিহাস বৃত্তাকার না বক্রাকার, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ইতিহাস ফিরে আসে কি না, এটা নিয়ে লম্বা আলাপ হতে পারে। তবে ইতিহাসের অনেক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। কাবুল দূতাবাস থেকে মার্কিন কূটনৈতিকদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা এটাই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাইগন থেকে কূটনীতিকদের নিয়ে শেষ মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টারটি উড়াল দেয়। এখন কাবুল থেকে শেষ বিমান ছাড়ার অপেক্ষা। ওই সময় উত্তর ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণের মুখে মার্কিনরা দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যায়। এবার কাবুল ছেড়ে চলে যাচ্ছে তালেবানের সম্ভাব্য অভিযানের মুখে।
ঘটনা দুটি অনেকটা একই রকম। ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তান, দুই দেশেই মার্কিনরা বাইরে থেকে এসে হামলা করেছিল। পার্থক্য কেবল ১৯৭৫ সালে কমিউনিস্টদের সঙ্গে হার মেনে ভিয়েতনাম ছেড়েছিল। এবার ইসলামপন্থী তালেবানের সঙ্গে না পেরে কাবুল পরিত্যাগ করছে। পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি অবশ্য কূটনৈতিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াকে কাবুল পরিত্যাগ বা পরাজয় বলে মানতে নারাজ। তাঁর মতে, নিজেদের লোকজনকে রক্ষা করতে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করা হচ্ছে। ভিয়েতনামের ঘটনার সঙ্গেও তুলনা করতে রাজি নন মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা। তবে এটা ১৯৭৫ সালের ঘটনারই ধারাবাহিকতা বলে অনেকে মনে করছেন।
মার্কিন ও ইউরোপীয়রা কাবুল থেকে নিজেদের লোকজনকে সরিয়ে নিচ্ছে আর ওদিকে বানের পানির মতো হুড়মুড় করে বিভিন্ন শহরে প্রবেশ করছে তালেবান। প্রতিদিনই নতুন কোনো না কোনো শহরে আশরাফ গনি সরকারের পতন ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা বলেছিল, ছয় মাসের মধ্যে তালেবান কাবুল দখল করবে। এখন এটা কমে তিন মাসে এসে ঠেকেছে বলা যায়।
তালেবানকে কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না আফগানিস্তানের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনী। তালেবানকে মোকাবিলায় সেনাপ্রধান পদে পরিবর্তন আনলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। বরং হতাহত মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। জাতিসংঘ দাবি করেছে, তালেবানের আগ্রাসনের মুখে দেশটিতে মানবিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পালিয়েছে। খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। পার্কে ঘুমাচ্ছে। গত দুই মাসে আড়াই লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছে।
তালেবানরা সীমান্ত এলাকায় স্থলবন্দরগুলো দখল করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য থামিয়ে দেওয়া। আফগানিস্তানে বহির্যোগাযোগের একমাত্র খোলা পথ হচ্ছে কাবুল বিমানবন্দর। কার্যত আশরাফ গনি সরকার কাবুলে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে।
অথচ শান্তিচুক্তির পর তালেবান একাধিকবার বলেছে, তারা সামরিক আগ্রাসন বা সমাধানের দিকে যাবে না; বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যতই দিন যাচ্ছে, তালেবান ততই আগ্রাসী হয়ে উঠছে। বিভিন্ন এলাকায় তুমুল যুদ্ধের সংবাদ পাওয়া গেলেও অনেকে জায়গায় আফগান সরকারি বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা বিনা প্রতিরোধেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে বা আত্মসমর্পণ করছে।
তালেবান থেকে আফগান সরকারি বাহিনীর শক্তিমত্তা কয়েক গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান সিজারের হিসাব মতে, আফগান সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৯৯। এদের এক-তৃতীয়াংশ যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এ ছাড়া সিআইএর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরকারি মিলিশিয়া যোদ্ধা আছে। এদের বিপরীতে তালেবান যোদ্ধাদের সংখ্যা ৭৫ হাজারের মতো হবে। কয়েক গুণ বেশি সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য নিয়ে তালেবানের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না; বরং তালেবানের হঠাৎ দ্রুত পুনরুত্থানে সবাই হকচকিত হয়ে গিয়েছে।
তালেবানের শক্তিমত্তার প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের কৌশলী কূটনীতি। তাঁরা একই সঙ্গে বিশ্বের সব কটি বৃহৎ শক্তির সঙ্গে দর-কষাকষির অবস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল। এমনকি নিরাপত্তার বিষয়ে শিয়া-অধ্যুষিত ইরানকেও তালেবান আশ্বস্ত করেছে।
বিপরীতে কাবুলের সরকার অতিমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। আশরাফ গনির সরকার বুঝতে পারেনি, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মিত্রতা কাবুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ভারত সরকার আফগানিস্তানকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছিল। ভারতের দেওয়া সামরিক হেলিকপ্টার কুন্দুজে তালেবান দখলে নিয়েছে। ভারতের তৈরি করা বাঁধও তালেবান নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে প্রথম দিকেই। ভারত আফগান সরকারের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করে পাকিস্তানের ওপর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে চাপ তৈরি করতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ও ইরানের বলয় থেকে বেরিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে বিকল্প একটি বলয় তৈরিতে আগ্রহী ছিল আফগান সরকার। ভারত ও আফগান সরকারের এই কৌশল কাজ করেনি; বরং আফগান সরকারের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কার্যত প্রতিবেশী কোনো দেশেরই সমর্থন পাচ্ছে না গনি সরকার। তবে ভারত সরকারও নানাভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মস্কো ও তেহরান সফর করেছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির অভিষেক অনুষ্ঠানে আশরাফ গনিসমেত উপস্থিত ছিলেন জয়শঙ্কর। কিন্তু পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না।
কূটনীতিতে তালেবানের কাছে আফগান সরকার একেবারেই কুলিয়ে উঠতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনার শুরুতেই আফগান সরকার এর অংশ হতে পারত। তালেবানরা বরাবরই আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অনাগ্রহী ছিল। তারা সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি করতে চেয়েছে। শান্তি আলোচনাকে দ্বিপক্ষীয় না করে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় পরিণত করা দরকার ছিল আফগান সরকারের। বরং আফগান সরকার তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী ছিল না। অথচ দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের আলোচনা শুরু হওয়ার পরও আফগান সরকারের হুঁশ ফেরেনি। এখন হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা অনুধাবন করতে পারছে গনি সরকার। তাই তালেবানদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ তালেবানদের সামনে এখন পুরো আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার সুযোগ। তাই তালেবানরা আফগান সরকারের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না।
কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়াও গনি সরকারের অধীনে বিশাল নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচারণা করা হলেও বাস্তবে তা নেই। সিজার ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে আফগান সরকারি বাহিনীতে ভুতুড়ে যোদ্ধাদের কথা উল্লেখ করেছে। এরা কাগজে-কলমে আছে। এদের নামে মাসে মাসে বেতন-ভাতা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের কোনো উপস্থিতি নেই। আফগান সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন ভুয়া নাম ব্যবহার করে নিজেরাই বেতন-ভাতা পকেটে পুরেছে। সিজারের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে ৫৮ হাজার ৪৭৮ জন নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যের হিসাব পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া সরকারি বাহিনীর বড় একটি অংশই তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে সব সময়। এসব কারণে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগান বাহিনীর পক্ষ থেকে তালেবানদের শক্ত কোনো প্রতিরোধের মধ্যে পড়তে হয়নি; বরং তালেবান সরকারের এসব দুর্নীতির প্রচারণা করে জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনসাধারণের সহায়তাও পাচ্ছে। কুন্দুজ আক্রমণের সময় তালেবানরা স্থানীয় লোকজনের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছিল বলে সরকারি গভর্নর জানিয়েছিলেন, যে কারণে সরকারি বাহিনীর পক্ষে নির্বিচারে হামলা করাও সম্ভব হয়নি।
আশরাফ গনির সরকারের সম্ভাব্য পরিণতি সবার জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিদেশি শক্তি ও বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সাময়িক সময়ের জন্য দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়।
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থেকে সম্ভব নয়; বরং দুর্দিনে আশপাশে কাউকেই পাওয়া যায় না। আশরাফ গনির সরকার এখন বড়ই একা। মনে হচ্ছে কাবুলে গনি সরকারের পতন সময়ে ব্যাপার মাত্র। এর বড় লক্ষণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কাবুলের দূতাবাস খালি করার ঘোষণা। যদিও শেষ মুহূর্তে শান্তিও চুক্তির জন্য আফগান সরকার ও তালেবানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। কিন্তু কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা তালেবান এ ধরনের শর্তে রাজি নাও হতে পারে; বরং তালেবান গনি সরকারকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের সুযোগ দিতে পারে। অন্যথায় কোনো ধরনের চুক্তি না করে তালেবান সামরিক অভিযান করেই কাবুলের দখল নেবে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। বড় ধরনের মিরাকল না ঘটলে কাবুল সরকারের জন্য কঠিন পরিণতিই অপেক্ষা করছে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক