পদ্মা সেতু রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুধু যোগাযোগব্যবস্থাকেই না, বদলে দেবে অর্থনীতিকেও। হবে কর্মসংস্থান, আয় বাড়বে আর হবে দারিদ্র্যবিমোচন। দেশের মোট ইপিজেড আটটির মধ্যে পদ্মার ওপারে আছে শুধু মোংলা ইপিজেড। এবার প্রস্তাবিত যশোর ও পটুয়াখালীর দুটিও চালু হবে। গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও পায়রা বন্দরেও ইপিজেড করার প্রস্তাব উঠেছে।
সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন এলাকাতেও মানুষের আনাগোনা বাড়বে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের জরিপে ৯৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, পদ্মা সেতুর কারণে কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ হবে। কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাবেন। কৃষকের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হবে। বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দরের পরিবহন ব্যবসায়ীরা বলেন, আগে যেখানে ২৪-৩৬ ঘণ্টা লাগত, এখন লাগবে ৬ ঘণ্টা। কেউ কেউ বলেন, কলকাতা থেকে ৫-৬ ঘণ্টায় ঢাকা আসা যাবে। ২০১৬ সালের খানা জরিপ অনুসারে কুষ্টিয়ায় যখন সবচেয়ে কম গরিব মানুষ ছিল, তখনো কুড়িগ্রাম ছিল দারিদ্র্যের শীর্ষে।
ওদিকে যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু হলো। নতুন করে রেলসেতুও হচ্ছে। কথা ছিল বগুড়া–গাইবান্ধা থেকে তিন ঘণ্টায় ঢাকা যাওয়ার; তিস্তার ওপার থেকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামবাসীর ৬ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানোর। কিন্তু বগুড়া, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলাবাসীকে নাটোর, চাটমোহর হয়ে ঘুরে আসতে হয়। যেখানে সিরাজগঞ্জ ৩ ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারে লালমনিহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে, সেখানে বাড়তি ৪ ঘণ্টা নষ্ট করতে হয়। শুধু বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ মাত্র ৩০ কিমি রেললাইন নির্মাণ করলেই এই অযৌক্তিক পথটা ঘুরতে হয় না। এটা রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলাবাসীর সঙ্গে রীতিমতো অপরাধ।
২.
চিলমারী থেকে সুন্দরগঞ্জের যোগাযোগের জন্য ১৪৯০ মিটার তিস্তা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে। সেই সেতু আজও শেষ হয়নি। এই সেতু হয়ে সড়কপথ গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার দূরত্ব কমবে বড়জোর ৫০ কিমি। লালমনিরহাট জেলার বেলায় দূরত্ব যা ছিল তা–ই থাকবে।
অন্যদিকে কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে ৫ ঘণ্টায় রাজধানীতে বাস পৌঁছায়। আর দেওয়ানগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা যাওয়া যায় দুই ঘণ্টায়। এই রুটের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ায় চিলমারী থেকে সড়কপথে ঢাকা যেতে লাগে ১০ ঘণ্টা আর কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে কুড়িগ্রাম থেকে ১১ ঘণ্টায়। অথচ রৌমারীর সঙ্গে বাসবাহী ফেরি যোগাযোগ থাকলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে বড়জোর লাগত সাত থেকে সাড়ে সাত ঘণ্টা। লালমনিরহাট জেলারও দূরত্ব কমে আসত। একইভাবে রংপুর ও নীলফামারীরও।
‘মানুষ চাঁদে গেল আমি ভালবাসা পেলুম/ তবু পৃথিবীতে হানাহানি থামল না’—আবুল হাসান লাইনগুলো লিখেছিলেন তাঁর ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন’ কবিতায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু তার সুফল চিলমারী, কুড়িগ্রাম, রংপুরের মানুষেরা পেলেন না। এবার অন্তত স্টিমার যোগাযোগটা চালু হোক!
৩.
গণকমিটির আন্দোলনে চিলমারী নদীবন্দর চালু হয়েছে। ভারত থেকে পাথর ও কয়লা আসছে। কিন্তু বন্দরে যাত্রী পারাপারসহ পণ্য লোড-আনলোডের ব্যবস্থা হয়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে। শোনা যায়, ২০০ কি ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দও হয়েছে এই খাতে। দীর্ঘদিন জেলা পরিষদের সঙ্গে মামলা চলছিল। ইজারাদারেরা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়েছেন। ঈদের সময় এই ঘাট যাত্রীতে লোকারণ্য হয়ে যায়। কথা ছিল, বিখ্যাত অষ্টমীর স্নানের জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দিরও নির্মিত হবে। ‘আমাদের দেখা হয়নি কিছুই, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস উৎসব...।’
ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া চিলমারী টু বাহাদুরাবাদ স্টিমার রুটটি ১৯৮৬ সালের দিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় একটি ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ফলে কুড়িগ্রাম ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তেমনি রৌমারী-রাজীবপুরের জনগণ ফেরি যোগাযোগ ও রমনা রুটে চলা চারটি লোকাল ট্রেন বন্ধ হওয়ায় সান্তাহার, পার্বতীপুর, চিলাহাটি ও লালমনিরহাটের সঙ্গেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই বিচ্ছিন্নতা থেকে সমৃদ্ধ জনপদটি দিনের পর দিন গরিব হতে থাকে।
৪.
যমুনা নদীতে সেতু চালু হলে সড়কপথে সিরাজগঞ্জের নগরবাড়ী-মানিকগঞ্জের আরিচা ঘাটের এবং রেলপথে বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি ঘাটের ফেরি সরিয়ে দক্ষিণ বঙ্গে নেওয়া হয়। পদ্মা সেতুও চালু হলো। এবার ফেরিগুলো কোথায় দেওয়া হবে?
ব্রিটিশ আমলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে আসামের আর্থসামাজিক সম্পর্ক ছিল। চিলমারী বন্দর, লালমনিরহাট রেল জংশন ছিল বাংলাদেশ ও আসামের কেন্দ্রে। তেমনিভাবে পদ্মার ওপারে খুলনা-কুষ্টিয়ার সম্পর্ক ছিল কলকাতার সঙ্গে। আর ঢাকার সঙ্গে ছিল ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রামের। ফলে পাকিস্তান আমলে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় দক্ষিণ বঙ্গের কাছে। তবুও শাসনক্ষমতায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা থাকায় পূর্ব পাকিস্তানে যে সামান্য বরাদ্দ হতো, তা উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে সমানভাবেই বণ্টিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গ পুরোপুরিভাবে দক্ষিণ বঙ্গের তুলনায় বঞ্চিত হয়। রংপুর বিভাগ আরও বেশি। এখানে ইপিজেড নেই, পর্যটন নেই, নেই চরগুলোকে বনে পরিণত করার উদ্যোগ।
‘মানুষ চাঁদে গেল আমি ভালবাসা পেলুম/ তবু পৃথিবীতে হানাহানি থামল না’—আবুল হাসান লাইনগুলো লিখেছিলেন তাঁর ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন’ কবিতায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু তার সুফল চিলমারী, কুড়িগ্রাম, রংপুরের মানুষেরা পেলেন না। এবার অন্তত স্টিমার যোগাযোগটা চালু হোক!
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge@gmail.com