১৯৭২ সালের ৩০ জুন। কুর্দিদের নেতা ইদরিস বারজানি ও মাহমৌদ উসমান এক গোপন সফরে ভার্জিনিয়ায় সিআইয়ের দপ্তরে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সিআইয়ের কিংবদন্তির পরিচালক রিচার্ড হেলমস। বারজানি ও উসমানকে এক চমকপ্রদ তথ্য দিলেন হেলমস। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ষাটের দশকে কুর্দিরা স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা–তদবির করেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পায়নি কুর্দিরা। আপাত সমর্থনের কথা জানালেও হেলমস জানাননি যে অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রের কুর্দি আবারও নীতি বদলে যাবে। ১৯৭৪ সালে ইরাকের মুখে কুর্দিদের ঠেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পিছটান দেয়। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র-কুর্দি সম্পর্কের বিবরণ এভাবেই দিয়েছেন হাওয়াই প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রায়ান আর গিবসন।
ইতিহাস বলে বারবারই যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। স্বার্থ হাসিল করে বিপদে ফেলে ভেগেছে। তাই সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চলে তুরস্কের হেমন্তে শান্তি আনয়নের অভিযানে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারে যাঁরা হা–হুতাশ করছেন, তাঁদের জেনে রাখা উচিত নব্বইয়ের উপসাগরীয় যুদ্ধের পরও সাদ্দাম হোসেনের থাবার সামনে তাদের ফেলে রেখে যুক্তরাষ্ট্র বেমালুম চলে গিয়েছিল। অথচ প্রেসিডেন্ট সিনিয়র জর্জ বুশের ডাকে সাড়া দিয়ে কুর্দিরা সাদ্দামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে পথে নেমেছিল। গণহত্যার শিকার হয়ে কুর্দিরা এর দায় শোধ করেছিল।
আরবের নতুন বাস্তবতায় কুর্দিরা কি আরও একটি গণহত্যার সামনে দাঁড়িয়ে? সময়েই নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে কুর্দিদের আবারও বাঘের মুখে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাচ্ছে। কুর্দিদের সঙ্গে পশ্চিমের প্রতারণা শুরু অটোমানদের পতনের পর থেকেই। জনশ্রুতি আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে পৃথক রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কুর্দিদের হাত করেছিল ইউরোপীয়রা। এরপর যুদ্ধের অবসান হলে ফ্রান্স ও ব্রিটেন কুর্দি এলাকা দখলে নেয়। পরে তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যে বণ্টন করে দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতির নাম কুর্দি। কুর্দিদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে পশ্চিমারা ব্যবহার করেছে। কখনো ইরাকের, সিরিয়া বা তুরস্কের বিরুদ্ধে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে সম্মুখসমরে কুর্দিরাই ছিল অগ্রভাগে। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্র হুট করে কুর্দিদের সমর্থন দিল কেন? উত্তর লুকিয়ে আছে ১৯৬৭ ও ১৯৭২–এর আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে ইরাকের অংশ নিতে না পারায়। কারণ, ওই সময় ইরাক উত্তরাঞ্চলে কুর্দিদের সামলাতেই ব্যস্ত ছিল। কুর্দিদের অস্ত্র, অর্থ দিয়ে ইরাককে ব্যস্ত রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৬৭ ও ৭২–এর যুদ্ধের পর সিনাই, গোলানসহ বিভিন্ন এলাকা ইসরায়েলের দখলে গেল। আর কুর্দিদের হাতে সমগ্র অঞ্চল অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কায় ৭৪–এ যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লিখেছে, কুর্দিদের সঙ্গে সবাই প্রতারণা করেছে। সাদ্দামের ইরাকের বিরুদ্ধে কুর্দিদের উসকে দেওয়ার পেছনে ইসরায়েল ও ইরানের হাত ছিল। এখন আবার আহত আইএস যোদ্ধাদের ইসরায়েল নিজ শহরে চিকিৎসা দিয়েছে বলে রবার্ট ফিস্ক বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন।
ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দি–অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে স্বাধীন কুর্দিস্তান গঠনের কথা অনেক দিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলে থাকেন কুর্দিস্তানকে পশ্চিমারা আরেকটি ইসরায়েল বানাতে চেয়েছিল। স্বাধীন কুর্দিস্তান গঠন করা সম্ভব হলে আরবের দেশগুলোকে দুই দিক থেকে চাপে রাখা যাবে। একদিকে ইসরায়েলের চাপ। অপরদিকে কুর্দিস্তানের চাপ। সব মিলিয়ে আরব দেশগুলো দিশেহারা অবস্থায় থাকবে। কিন্তু কুর্দিরা এখনো পশ্চিমাদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাই এই প্রকল্পও আটকে আছে। তুরস্কের সিরিয়া অভিযান এর বড় উদাহরণ।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, আইসিসের বিরুদ্ধে কুর্দিদের সাফল্য, ইরাকে কুর্দিদের জন্য পৃথক অঞ্চল গঠনে অনেকেই মনে করেছিলেন কুর্দিস্তান এবার স্বাধীন হতে পারে। কিন্তু সিরিয়া যুদ্ধের নানা পক্ষের অংশগ্রহণ সম্ভাব্য কুর্দিস্তানের ভব্যিষৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তুরস্কের অপারেশন পিস স্প্রিং সব জল্পনাকে আরও ফিকে করে দিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুর্দিরা এখন রাশিয়া ও সিরিয়ার সরকারি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে। কুর্দি বাহিনীর কমান্ডার মজলৌম আবদির মতে, কুর্দিদের জন্য দুটি বিকল্প আছে। গণহত্যার শিকার হওয়া অথবা সমঝোতা করা। শেষ পর্যন্ত কুর্দিদের সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স তথা বাশার আল–আসাদের সঙ্গে সমঝোতাই করতে হলো। এত দিন এসডিএফ পেন্টাগনের অর্থে ও অস্ত্রে বাশারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মূলত বাশারকে ক্ষমতা থেকে টলিয়ে দিতেই কুর্দিরা সমবেত হয়েছিল ২০১১ সালে আরব বসন্তের ধাক্কায়। সেই কুর্দিরা এখন সেই অস্ত্র ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের বিপরীতে ধরবে।
তুরস্ক কখনই কুর্দিদের উত্থানকে মেনে নেবে না। ২০১২ সালের জুলাইয়ে কুর্দিস ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (কেওয়াইডি) সিরিয়ার সীমান্তে একটি ছোট শহর দখল করে নেয়। কেওয়াইডি হচ্ছে তুরস্কের কুর্দি সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পাটির (পিকেকে) সিরীয় অংশ। স্বভাবতই তুরস্ক কুর্দিদের বিষয়ে শুরু থেকেই সতর্ক ছিল। পিকেকে ১৯৮৪ সাল থেকে আংকারার বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ করছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইএসের বিরুদ্ধে লড়ে কুর্দিরা সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নিয়ে নেয়। কুর্দিদের সংগঠন সিরিয়ার ডেমোক্রেটিক ফোর্স এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং আইএসকে পরাজিত করে। যদিও সিরিয়ার অনেক নাগরিকই মনে করেন, বস্তুত সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতে আইএস পরাজিত হয়েছে। পেছনে ছিল রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ। শুরুতে তুরস্ক কুর্দিদের নড়াচড়াকে সাময়িকভাবে মেনে নিলেও শর্ত দিয়েছিল কুর্দিরা যেন ফোরাত নদী অতিক্রম করতে না পারে। কিন্তু কুর্দিরা ক্রমশই শক্তি সঞ্চয় করে ফোরাত অতিক্রম করে তুরস্কের সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
আইএস যখন মোটামুটি পরাজিত, ঠিক সেই মুহূর্তে কুর্দি–সংকটের উদ্ভব। তুরস্ক বলছে বটে, সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জঙ্গিমুক্ত করে উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তবে এটাও সাদাচোখে বোঝা যাচ্ছে যে, মূলত কুর্দিদের শায়েস্তা করতেই তুরস্কের এই অভিযান। কার্যত কুর্দিরা এখন সবদিক থেকেই চাপের মুখে আছে। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের তুরস্কের হামলার মুখে ফেলে শুধু ভাগেইনি বরং ডোনাল্ড ট্রাম্প কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, কুর্দিরা আটক আইএস জঙ্গিদের মুক্ত করে দিচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, তুরস্কের সমর্থনপুষ্ট যোদ্ধারাই আইএসের জঙ্গিদের মুক্ত করে দিচ্ছে।
সিরিয়ার যুদ্ধ খুবই জটিল। একে সাধারণ তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করা কঠিন। এখানে কে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলা মুশকিল। ক্ষণে ক্ষণে এর রং বদলায়। সবাই আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সবার হামলায় কেবল সাধারণ মানুষ মারা যায়। তবে এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই হারেনি। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো পক্ষ পরাজিত হয়, তবে তা হবে কুর্দিদের।
আর তুরস্কের সিরিয়া অভিযানে সব থেকে বেশি লাভবান হচ্ছে ইসলামিক স্টেট। ইতিমধ্যেই কুর্দি কমান্ডার বুধবার আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ স্থগিত করেছে। আটক কয়েক হাজার আইএস যোদ্ধা মুক্ত হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। তুরস্কের হামলা আইএস যোদ্ধাদের সিরিয়ার ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নিরাপদ পথ করে দিচ্ছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ, আইএস যোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের সহায়তার তথ্য এখন কমবেশি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আল নুসরা ফ্রন্টের সঙ্গে তুরস্কের যোগাযোগও নতুন কিছু না। গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে আইএসকে ঢোকানো হয়েছিল। এখন মূলত তাদের নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এমনও হতে পারে, এই আইএস যোদ্ধাদের নতুন কোনো দেশে নতুন কোনো ফ্রন্টে দেখা যাতে পারে। এটা একেবারেই অসম্ভব কিছু না।
** ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন