মতামত

কুমিল্লায় কেউই জেতেনি, হেরেছে নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশনের ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রস্তুতি সত্ত্বেও প্রবল উত্তেজনা, ব্যাপক হট্টগোল ও এক অনাকাঙ্ক্ষিত নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। বরাবরের মতো এ নির্বাচনেও জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে এবং মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত সাবেক মেয়র মনিরুল হককে মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন।

দুর্ভাগ্যবশত, মনিরুল হক ছাড়াও এ নির্বাচনে আরও অনেক পরাজিত পক্ষ রয়েছে। আমাদের মতে, এ নির্বাচন শোচনীয়ভাবে হেরেছে নির্বাচন কমিশন। ইভিএমেরও এ নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছে। উপরন্তু সরকারি দলও কুমিল্লার নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি।

প্রথমত, এ নির্বাচনে বিদ্যমান বিধিবিধান প্রয়োগে নির্বাচন কমিশন সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি। ৭ জুন সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ২২ ধারার অধীন ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি হিসেবে ‘কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায়’ অংশগ্রহণ করার অভিযোগে বাহাউদ্দিন বাহারকে অনতিবিলম্বে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের অনুরোধ করে নির্বাচন কমিশন, যা মাননীয় সংসদ সদস্য অমান্য করেন—আমাদের জানামতে, অতীতে এমন কখনো ঘটেনি। বিধিমালার ৩১ ও ৩২ ধারায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের শাস্তির, যেমন জেল-জরিমানা ও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান থাকলেও কমিশন তা প্রয়োগ করেনি, যদিও চুনোপুঁটিদের বেলায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে কমিশন পিছপা হয়নি। বরং প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেন যে একজন সংসদ সদস্য এভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাঁদের কিছুই করার নেই। আরেকজন কমিশনার বলেন যে সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানহানি করা কমিশনের কাজ নয়। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সিইসি দাবি করেন, সংসদ সদস্যকে ‘আমরা স্থান ত্যাগ করতে বলতে পারি না এবং বলি নাই। কাজেই তিনি কিছু ভঙ্গ করেন নাই। আমরাও ব্যর্থ হই নাই’ (প্রথম আলো, ২১ জুন ২০২২)। এমন আত্মসমর্পণমূলক ও অসংলগ্ন বক্তব্যের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে জনসমক্ষে শুধু হেয়প্রতিপন্নই করা হয়নি, বিধিবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপারগতার কারণে কমিশনের সদস্যরা ‘আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালনে’র শপথও ভঙ্গ করেছেন।

এ ছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে, যার একটি কারণ হলো নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের অসংগতিমূলক বক্তব্য। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর মনিরুল হক ৬২৯ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এরপর ফলাফল ঘোষণা ৪৫ মিনিট বন্ধ থাকে, রিটার্নিং কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, চারটি কেন্দ্রের ফলাফল পেতে বিলম্বের কারণে এমনটি হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়েছিল। সিইসির নিজের ভাষ্যে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ‘ন্যাচারাল কলের কথা বলে ওয়াশরুমে গেছেন...আর সেই ৫ মিনিটে সব ভোট পাল্টে যাবে, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’ আরেকজন কমিশনার বলেন, ‘১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর যে সমস্যা হলো, ওই সময় ফলাফল ঘোষণার পরিবেশ ছিল না। ওই সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন যে এমন কিছু ঘটে কি না, যাতে ফলাফল শিট ও ল্যাপটপের কিছু হয়ে যায়। তিনি এই ভয়ে ছিলেন’ (প্রথম আলো, ২০ জুন ২০২২)। অর্থাৎ রিটার্নিং কর্মকর্তা যেখানে চারটি কেন্দ্রের ফলাফল পেতে বিলম্বের কারণে ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল বলে দাবি করেছেন, সেখানে কমিশন ন্যাচারাল কল ও মালপত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি কারণ হিসেবে দেখায়। এ ছাড়া কমিশনের পক্ষ থেকে ফলাফল প্রকাশ মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্ধ সময়ের পরিমাণ ছিল ৪৫ মিনিট। কমিশনের পক্ষ থেকে এমন অসংগতিমূলক বক্তব্য সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসলে জয় পায়নি। কারণ, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জনগণকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভবিষ্যতে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। একজন দলীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনী আচরণবিধি এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্য করা সত্ত্বেও দলের নীরব অবস্থান জনমনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি না করেও পারে না। তাই এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলও যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদের ফলাফল নিয়ে সন্দেহের আরেকটি বড় কারণ হলো চারটি কেন্দ্রের ফলাফল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা বিলম্ব। ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভোট গ্রহণ বন্ধের পরপরই ফলাফল পাওয়ার কথা থাকলেও কেন এসব কেন্দ্রের ফলাফল এত দেরিতে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছাল? দেরিতে পাওয়া এসব কেন্দ্রের ফলাফল কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করত না, যদি না এর মাধ্যমে ১০১ কেন্দ্রের ফলাফলের ভিত্তিতে ৬২৯ ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থী অনেকটা অলৌকিকভাবে ৩৪৩ ভোটে হেরে না যেতেন। এখানে কোনোরূপ তেলেসমাতি কাজ করেছে কি না, তা একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে, যা না হলে কমিশনের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।

কুমিল্লার নির্বাচনে আবারও প্রমাণিত হলো যে বায়োমেট্রিক্সভিত্তিক ইভিএম ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে গত জাতীয় নির্বাচনে যে ২৯৪টি আসনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়নি, সেখানে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০, যার বিপরীতে যে ৬ আসনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছিল, সেখানে সে হার ছিল মাত্র ৫১ দশমিক ৫৪, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ কম। কুমিল্লার নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের কারণে ভোট পড়ার হার কমেছে। ২০১২ সালে, যখন একটি ভিন্ন মডেলের ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল, তখন ভোট পড়ার হার ছিল ৭৫, পক্ষান্তরে পেপার ব্যালট ব্যবহার করে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৬৩ দশমিক ৯২, যা এবার ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তাই যে যন্ত্র নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করে, যেকোনো নির্বাচনে তার ব্যবহার সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

আমাদের ইভিএমের আরেকটি সমস্যা হলো এর কারিগরি দুর্বলতা, যে দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল জালিয়াতি করা সম্ভব। কুমিল্লার নির্বাচনে যা ঘটার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের ব্যবহৃত ইভিএমে কোনো ‘ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার কারণে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফলই চূড়ান্ত। কারণ, এই ফলাফল পুনর্গণনা বা অডিট করা যায় না। সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত যেকোনো যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে আমাদের ইভিএম দিয়েও জালিয়াতি করা যায়। এ ছাড়া ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা ব্যবহার করেও নির্বাচনী ফলাফল পাল্টিয়ে দেওয়া যায়। প্রসঙ্গত, বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ইভিএমের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ ওভাররাইড করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। তাই আমাদের ইভিএমের নির্ভরশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করে ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’ বা মেশিনের পেছনে কারা আছেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। উল্লেখ্য যে গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুবার ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যা ডিজিটাল জালিয়াতিরই প্রতিফলন। আর এসব দুর্বলতার কারণেই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বর্তমান ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি।

নির্বাচনী ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর মনিরুল হক দাবি করেন যে তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকার কারণে ফলাফল পুনর্গণনার কোনো সুযোগ নেই, তাই তাঁর অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা প্রমাণ করাও সম্ভব হবে না। প্রসঙ্গত, এ দুর্বলতার কারণে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি সংযুক্ত করতে বাধ্য হয়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসলে জয় পায়নি। কারণ, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জনগণকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভবিষ্যতে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। একজন দলীয় সংসদ সদস্যের নির্বাচনী আচরণবিধি এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্য করা সত্ত্বেও দলের নীরব অবস্থান জনমনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি না করেও পারে না। তাই এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলও যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

  • বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)