মতামত

কুমিল্লার ঘটনা আমাদের যে বার্তা দিচ্ছে

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মো. সোহেল এবং তাঁর সহযোগী হরিপদ সাহাকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামিসহ তিনজন ৪৮ ঘটনার ব্যবধানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়েছে, এই নিয়ে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও অন্যদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে (প্রথম আলো, ২ ডিসেম্বর ২০২১)। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো মামলার আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেলেন তা নয়, বরং এই ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে। অনেক সময় যেসব অপরাধের ঘটনা আলোচিত হয়, সেসব ঘটনায় অভিযুক্তদের এই পরিণতি হয় দ্রুত। প্রায় এক দশক ধরে আমরা তা–ই দেখতে পাচ্ছি। এই ধরনের ঘটনা এতটাই স্বাভাবিক বলে পরিগণিত যে এখন এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোও আর কথা বলার দরকার মনে করে বলে মনে হয় না। এর কারণ বুঝতে নিশ্চয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার হয় না।

কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে, সেটি ২২ জুন ২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন আমাদের জানাচ্ছে, ‘কয়েক বছর ধরে সরকারের জন্য স্পর্শকাতর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সোচ্চার হওয়া কমে যাচ্ছে। যেমন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যু কিংবা গায়েবি মামলার মতো ঘটনা। বিপন্ন মানুষের যাওয়ার জায়গা ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়ছে।’ গত আড়াই বছরে এই অবস্থার যে আরও অবনতি হয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য।

দেশে যে একটি মানবাধিকার কমিশন আছে, সেই সংস্থা পর্যন্ত এখন আর এ বিষয়ে কথা বলতে বা তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে চায় না। এই কমিশনের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের কার্যক্রমের মূল্যায়নে দেখা যায়, গোড়াতে এই সংস্থা মৃদু স্বরে যা-ও বলত, তা এখন অনুপস্থিত তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো সুরেই গান গায়।

জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা এক দিনে গড়ে ওঠে না, বাংলাদেশেও তা গড়ে ওঠেনি। উঠেছে ধাপে ধাপে। নাগরিকদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে এর সূচনা, কিন্তু তা কেবল নির্বাচন বা ভোটাধিকারের মধ্যে সীমিত নেই, থাকার কথাও নয়। প্রতিদিনই নতুন নতুন ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদের রূপ এইভাবেই প্রকাশিত হয়; ভবিষ্যতে তার আরও বিভিন্ন প্রকাশ ঘটবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ সরকারের জন্য ‘কিছুটা ইমেজ–সংকটের’ সৃষ্টি করছে। তবে সরকারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে (প্রথম আলো, ৩১ আগস্ট ২০২১)। কমিশন এগুলোকে অভিযোগ বলছে, কিন্তু তদন্ত করে অভিযোগের সুরাহা করেনি।

লক্ষণীয়, যদিও এই ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই যুক্ত থাকে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের কোনো এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনের নেই। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেছেন, ‘আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের এখতিয়ার কমিশনের নেই। আর মানবাধিকার লঙ্ঘন মানে শুধু এসব অধিকারের লঙ্ঘন নয়; বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি অন্যতম হলেও আরও অনেকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়’ (প্রথম আলো, ৩১ আগস্ট ২০২১)। অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কমিশন কী করে, তা–ও খুব স্পষ্ট নয়। কমিশনের এই এখতিয়ার না থাকাটা এবং এ বিষয়ে কমিশনের কোনো রকমের উচ্চবাচ্য না করা সবার জন্য একটা বার্তা।

বার্তাটি কী, সেটা বোঝার জন্য কুমিল্লায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনজন মারা যাওয়ার পর সাংবাদিকের কাছে সেখানকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সোহান সরকারের দেওয়া বক্তব্য শোনা দরকার। তিনি বলেছেন, নিহত ব্যক্তিরাই ‘পরিকল্পনাকারী, হত্যাকারী’। যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁদের বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই বলা হচ্ছে ‘হত্যাকারী’। তিনি আরও বলেন, ‘যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা তো ছোটখাটো কেউ নন। তাঁদের ঘটনা সমাজে বার্তা দিল, অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না।’ একজন পুলিশ কর্মকর্তা কার্যত বলেছেন, ‘অপরাধ করে পার না পাওয়ার’ উপায় হচ্ছে বিনা বিচারে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া; আদালতে বিচার নয়, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নয়, দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়।

পুলিশ কর্মকর্তার এই কথা আসলে বিভিন্নভাবেই বলা হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন আচরণের মধ্য দিয়ে এক দশক ধরেই তা প্রচার করা হচ্ছে। সংবিধানে কী আছে, সেটা এখন আর ধর্তব্যের বিষয় থাকছে না, এমনকি বিচার পাওয়ার অধিকারও নয়। অন্যথায় সংবিধানে নাগরিকের সমাবেশের অধিকার থাকা সত্ত্বেও গত এক দশকে বিরোধী দলগুলো কেন সমাবেশ করতে সক্ষম হয় না, কিংবা তাদের জন্য সমাবেশের অনুমতি মেলে না, যখন সরকারি দল চাইলেই যত্রতত্র সমাবেশ করতে সক্ষম হয়? নতুন গঠিত গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে যেখানেই গেছেন, তাঁদের ওপর হয় পুলিশ হামলা করেছে, নতুবা তাঁদের উপস্থিতিতেই ছাত্রলীগের কর্মীরা চড়াও হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন। দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর সতীর্থরা যে কেবল পুলিশি বাধার মুখে পড়ছেন তা নয়, তাঁদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে। এসবের মধ্যে যে বার্তা স্পষ্ট, তা হলো শক্তি প্রয়োগ করে শাসন করা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এ নিয়ে কথা বলার জায়গাও সীমিত, কথা বলার চেষ্টা যে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের আওতায় অভিযুক্তদের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়। অন্যদিকে এমনকি যাঁদের অপরাধ প্রমাণিত এবং ‘লঘুদণ্ডে’ দণ্ডিত, তাঁদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হচ্ছে।

এগুলো হচ্ছে জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এখন আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয় এই কারণে যে জবাবদিহির যে দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ছিল, সেগুলো সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। সংসদে জবাবদিহি করার দরকার হয় না, ২০১৪ সাল থেকেই একদলীয় সংসদ চালু থেকেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দুর্বল, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বাইরে তারা যে উচ্চকণ্ঠ হতে অপারগ, তার প্রমাণ হচ্ছে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের বিনা বিচারে ‘হত্যাকারী’ বলা নিয়ে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী প্রশ্নের মুখোমুখি হন না। বরং এই রকম বলাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি নিয়মমাফিক যা করা দরকার, সেটা করতেও দ্বিধান্বিত। সংকটের মাত্রা এবং বিরাজমান শাসনের ভবিষ্যৎ পথরেখা তারা বুঝতে অপরাগ, না অনীহ, সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা এক দিনে গড়ে ওঠে না, বাংলাদেশেও তা গড়ে ওঠেনি। উঠেছে ধাপে ধাপে। নাগরিকদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে এর সূচনা, কিন্তু তা কেবল নির্বাচন বা ভোটাধিকারের মধ্যে সীমিত নেই, থাকার কথাও নয়। প্রতিদিনই নতুন নতুন ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদের রূপ এইভাবেই প্রকাশিত হয়; ভবিষ্যতে তার আরও বিভিন্ন প্রকাশ ঘটবে।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো