আমরা জানি, এই নির্বাচনে যে-ই জিতুক জনগণ জিতবে না। কারণ, জনগণের পক্ষের কোনো দল নির্বাচনে জোরালোভাবে নেই। ক্ষমতায় যারা আছে, তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই নির্বাচনে ভোট চাইছে। ১০ বছর একটানা ক্ষমতায় ছিল, আরও পাঁচ বছর থাকার ইচ্ছা। ক্ষমতাসীনদের শাসনের অধীনে অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে, কোনোটাই সুষ্ঠু হয়নি, যে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এবার তত্ত্বাবধায়ক নেই, ক্ষমতাসীন দল আছে। ১০ বছরে তারা যে সুবিধাগুলো পেয়েছে এবং তৈরি করে নিয়েছে—সবগুলোই তারা দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করেছে।
বিরোধীপক্ষের ওপর সরকারের যে দমনমূলক নীতি, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার তৎপরতা, তাতে বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিতে সাহস করবে না, এমন আশঙ্কা ছিল। আবার নির্বাচনে অংশ না নিলে বিরোধীদের অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার কথা। তদুপরি প্রধান বিরোধী দলের নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যেত।
কিন্তু দুই দল ও জোটেরই আদর্শগত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। সরকার বলেছে তোমরা ভোট দাও, আমরা উন্নতি দেব। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, উন্নতি যে রাস্তায় এখন এগোচ্ছে, সেই রাস্তাতেই কি চলবে? এই উন্নতির অর্থ তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় বৈষম্য বৃদ্ধি। উন্নতি যা হচ্ছে, সেটা কতিপয়ের। তাদের কেউ কেউ বুলেটের গতিতে উন্নতি করছে এবং টাকাপয়সা যা করছে, তা বিদেশে পাচার করছে। এই উন্নতিতে বঞ্চিত মানুষ, যাদের সংখ্যা শতকরা ৮০ জন, তাদের উপকারটা কোথায়? উন্নতি যে ঘটছে, তার কারণ মানুষের শ্রম, আর বঞ্চিত তো হচ্ছে সেই শ্রমজীবীরাই।
বিরোধীদের আওয়াজটা ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের। কিন্তু গণতন্ত্র তো কেবল ভোটের ওপর নির্ভর করে না, গণতন্ত্রের মূল কথাটাই হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা, তার কথা কি তারা ভাবছে?
এই নির্বাচন যে কাজটা বেশ সুন্দরভাবে করল, সেটা হলো বুর্জোয়া রাজনীতির ভেতরকার অন্তঃসারশূন্যতার অধিকতর উন্মোচন। টাকার দৌরাত্ম্যের কথা বাদই দিলাম, সেটা তো ঘটলই। কিন্তু দলবদল? সেটা ঘটল কোন টানে? সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটালেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনের অত্যন্ত কঠিন সমালোচক ছিলেন, কিন্তু যোগ দিয়েছেন নৌকাতে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার তিনি রাজনীতিতে এসেছেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে; ছিলেন বিএনপির প্রথম মহাসচিব; দলের প্রার্থী হিসেবে এমপি, মন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতিও হয়েছেন। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলত; বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন ওই আদর্শের সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ প্রচারক। অপরদিকে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে।
সুবিধাবাদ জিনিসটা এই নির্বাচনে বেশ ভালোভাবেই সামনে এল। যাঁর যেদিকে সুবিধা, তিনি সেদিকে গেছেন। সবশেষে গেলেন ইনাম আহমদ চৌধুরী। শোনা যাচ্ছিল বিএনপির হয়ে লড়বেন। মনোনয়ন পাননি, না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছেন আওয়ামী লীগে। এতকাল যে বিএনপিতে ছিলেন, তার কারণ কী? সুবিধা? বিএনপির শাসনামলে তিনি প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই বোর্ডের প্রধান কীর্তি আদমজী পাটকলের বিলোপসাধন। দেশের জন্য কাজটা ছিল ভয়ংকর ক্ষতির। অথচ তিনি বলেছিলেন, পাটকলটি একটা অজগর, সবকিছু গিলে খাচ্ছে, তাকে শেষ না করলে পরিণতি দাঁড়াত ভয়াবহ। দেশবাসী জানে, ওই প্রাইভেটাইজেশন সবকিছু গিলে খেয়ে ফেলছে। প্রাইভেটাইজেশন বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান সাহেব যে আমলাতান্ত্রিক জীবন শেষে রাজনীতিতে এসেছিলেন এবং এখন দলবদল করলেন—
তাতে বোঝা গেল তাঁর কাছে প্রাইভেটই আসল বিবেচ্য, পাবলিক হচ্ছে প্রাইভেটের জন্য ব্যবহার্য এজমালি সম্পত্তি।
এই নির্বাচনে সরকারি দল যে তার প্রধান প্রতিপক্ষকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলবে, তার কোনো উপায় নেই। প্রতিপক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, সে হিসেবে তাঁরা খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। অন্যদিকে আবার যুদ্ধাপরাধীরাও দুই পক্ষেই রয়েছে। বিএনপি ২২ জন ‘যুদ্ধাপরাধী’র তালিকা হাজির করেছে, যাঁরা নৌকা মার্কায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর)। ইসলামপন্থীরাও দুই দিকেই রয়েছে। তাদের গোপন আদর্শও ওই একই, সুবিধাবাদ। যে দিকে সুবিধা বেশি, সেদিকেই যাবে, সে কাজে তাদের কোনো অসুবিধা নেই।
সরকারের পক্ষে সরকারি লোকেরা থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এই নির্বাচনেও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রশাসন তৎপর ছিল সরকারি দলের যাতে কোনো অসুবিধা না ঘটে, সেটা দেখতে। শুধু কর্মরতরা নন, আমলাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত অসামরিক ও সামরিক বড় বড় কর্মকর্তাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনে তাঁর সাফল্য কামনা করেছেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারকে সমর্থন করবে, এতে অস্বাভাবিকতা নেই, কিন্তু তারা যদি সরকারি দলের দলীয় কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সেটা যে নাগরিকদের স্বার্থ ও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য শুভসংবাদ হবে না—এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যবসায়ীরা সভা করে জানিয়েছেন যে তাঁরা চান বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যাতে অক্ষুণ্ন থাকে। বলা বাহুল্য, ওই উন্নয়নে তাঁরা অংশীদার, তাঁদের কারও কারও উন্নতির দ্রুতগামিতা সারা বিশ্বে চমকের সৃষ্টি করেছে। এত গরিব দেশে তাঁদের এত সম্পদ! কিন্তু সে সম্পদ তাঁরা দেশে রাখছেন না, পাচার করে দিচ্ছেন বিদেশে।
নির্বাচনে টাকা যা খরচ হচ্ছে তার অনেকটাই যাবে বেকার যুবকদের হাতে। এদের লুম্পেন বলা হয়। এরা দলের ভক্ত নয়, টাকার ভক্ত। বাংলাদেশে উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু কর্মের সংস্থান বাড়ছে না; মেহনতিদের শ্রমের ওপর নির্ভর করা উন্নতি কর্মহীনতা কমাচ্ছে না, বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে বেকার সমস্যার ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করার কথা দেশের শাসকশ্রেণিকে, কারণ এই সমস্যা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে; নির্বাচন উপলক্ষে লুম্পেনরা হাতে নগদ টাকা পাবে, উৎফুল্ল হবে, কিন্তু নির্বাচন শেষে এরা যখন দেখবে টাকার উৎস শুকিয়ে গেছে, তখন টাকার জন্য তারা নানা রকমের অপরাধে লিপ্ত হবে। ফলে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়বে, খুন-জখম-ধর্ষণ এখনই ভয়াবহ, ভবিষ্যতে তা যে আরও বাড়বে; এমনটা না ভাবার কোনো কারণ নেই।
ইসলামপন্থী দলগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী পুরোনো পাপী, তাদের নৃশংসতার খবর আমরা রাখি; কিন্তু হেফাজতপন্থীরা যেভাবে কদম কদম এগিয়ে যাচ্ছে, আবার প্রশ্রয়ও পাচ্ছে, তা–ও কম বিপজ্জনক নয়। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সময়ে তাদের নৃশংসতার কিছু নমুনা ঢাকাবাসী পেয়ে গেছে। তাদের দাবিগুলোর কয়েকটির ভয়াবহতা অতুলনীয়; যেমন ধর্মদ্রোহিতা আইন চালুর দাবি। এই আইন পাকিস্তানে চালু আছে; ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে এটা চালু করার দাবি কেউ কখনো তুলতে পারবে—এটা ছিল কল্পনার বাইরে! ইতিমধ্যে তাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে; তাদের দাবি অনুযায়ী বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তকে উদ্ভট সব পরিবর্তন আনা হয়েছে (তারা অবশ্য ইংরেজি মাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করেনি; ওই মাধ্যম তাদের নাগালের বাইরে।)। তাদের দেওয়া শিক্ষা সনদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমর্যাদা দানের সরকারি সিদ্ধান্ত এর মধ্যেই গৃহীত হয়ে গেছে।
এসব ঘটনা যে মোটেই সুসংবাদ নয়, সেটা বুঝতে কোনো কষ্ট নেই। সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝে দেশের ধনীরা। তারা তাই তাদের ভবিষ্যৎ দেশে না গড়ে বিদেশে গড়ে তুলছে। দেশে তারা কওমি মাদ্রাসার জন্য টাকা ঢালে, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠায়, যে বিদেশ থেকে ওই তরুণেরা আর কখনো ফিরবেন না। নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটা দেশের ভেতরে থেকে না দেখে নিরাপদে বাইরে বসে দেখার জন্য ইতিমধ্যেই অনেকে বিদেশে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন বলে জানা যাচ্ছে। এয়ারলাইনসের টিকিটের সংকট দেখা দিয়েছে। (বণিক বার্তা, ২৫ ডিসেম্বর)।
মূল কথাটা হচ্ছে, এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। ব্যক্তিমালিকানা বিলোপে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। সে কাজটা করার নেতৃত্ব দিতে হবে দেশের বামপন্থীদেরই। কিন্তু মুশকিল হলো, বামপন্থীরা শক্তিশালী নন। তাঁদের শক্তিশালী হতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার তাঁদের পছন্দ করে না। আর সংবাদমাধ্যম তো পুরোপুরিই তাঁদের বিপক্ষে; তার কারণ হলো গণমাধ্যমের মালিকেরা সবাই ব্যক্তিমালিকানার পক্ষে।
ইসলামপন্থী দলগুলো যে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে এবং সামাজিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তার প্রধান কারণ কিন্তু এই যে ধনীদের মতো এরাও ধনী-গরিবনির্বিশেষে ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসী। আগামী দিনে দেশে নৌকা ও ধানের শীষই থাকবে, অন্যদের তেমন একটা দেখা যাবে না—এটা অনেকের ধারণা। কিন্তু ধানের শীষ যেভাবে কোণঠাসা হচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সে কতটা সংগঠিত হতে পারবে বলা মুশকিল। সংগঠিত হতে যদি না-পারে তাহলে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবে? বামপন্থীরা যে হতে পারছে না, তা বোঝা যায়, বুর্জোয়ারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতেও চাইবে না। সে ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দলগুলোই হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেবে। সেটা যে ভালো কোনো ব্যাপার হবে না, তার প্রমাণ মার্কিন আধিপত্যে বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আমরা নিশ্চয়ই মধ্যপ্রাচ্য করতে চাইব না। হতাশা থেকে বের হয়ে আসার প্রকৃষ্ট পন্থা ওইটাই, সমবেত হওয়া, সংঘবদ্ধ হওয়া, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক