প্রশ্নটা বেশ সহজ, ফেসবুকে ভুয়া খবরের দায় আসলে কার? সংবাদপত্র বা বইপত্র, যেখানেই লিখুন, সম্পাদনা হবেই। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপারটা সে রকম না। লোগান পলের কথাই ধরুন, ২০১৭ সালের শেষের দিকে এই ইউটিউবার জাপানের আওকিগোহারা জঙ্গলে এক আত্মঘাতী ব্যক্তিকে পুরোটা ভিডিও করেন।
এখন সাংবাদিক মাত্রই জানেন, এমন কিছু প্রকাশ করা উচিত নয়। কিংবা সেটা যদি সম্পাদকদের কাছেও যায়, তাঁরা সাংবাদিকতার প্রতি এবং ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এমন কোনো কিছু প্রকাশ করবেন না। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বলছে, সামাজিক মাধ্যমের প্রথম দিকে বিষয়টি এ রকম ছিল না। মাইস্পেস বা এ রকম সামাজিক মাধ্যমের উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারনেটের লোকদের কথা বলার পরিসর দেওয়া, নিজের মতো করে বলার সুযোগ করে দেওয়া। বিষয়টি একদম আইন করেই দেওয়া।
তবে এই ব্যাপারে ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের মতামত একটু আলাদা। তাদের ধারণা, সামাজিক মাধ্যমের আঁতুড়ঘর যুগে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া যায়। তবে সেটা একেবারে আইন করে নয়। একটি বিষয় লক্ষণীয়, এই সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর সবার শিকড় কিন্তু আমেরিকায়। যেখানে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বলে খোদ রাষ্ট্রপ্রধানকে গালাগাল দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া যায়।
তাই সংবিধান আর ১৯৯৬ সালের আমেরিকান কমিউনিকেশন ডিসেন্সি অ্যাক্ট সামাজিক মাধ্যমগুলোকে বড় হতে দিয়েছে। তখন তাদের বাতায়নে পাওয়া তথ্যে তেমন দেখভাল করার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার। তখন সামাজিক মাধ্যমের যাত্রা মাত্রই শুরু হচ্ছে, ও রকম কড়া নজরদারিতে রাখলে পরে তাদের বেড়ে ওঠা হতো না। আমেরিকান পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্টের মতও সে রকমই।
টুইটার কিংবা ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো তাদের কোম্পানিকে যোগাযোগের উসকানিদাতা হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। তারা ভাবে, তারা মতপ্রকাশের জায়গা করে দিচ্ছে, যোগাযোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে নতুন কিছু সৃষ্টি করছে না। আইনপ্রণেতাদের যুক্তি ছিল, আঁতুড়ঘরে থাকা এই ইন্ডাস্ট্রি খরুচে মামলা-হামলা সামলাতে পারবে না। যত যা-ই হোক, আমেরিকানরা বাণিজ্য বোঝেন বেশ।
তবে ২০১৮ সালের প্রায় শেষে এসে এই যুক্তি আর খাটে না। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, আমেরিকার অর্ধেকের কাছাকাছি প্রাপ্তবয়স্ক ভোক্তা খবর পান তাঁদের ফেসবুক পেজ থেকে। ইউটিউবের ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ব্যবহারকারী দৈনিক ২ বিলিয়নের বেশি ভিডিও স্ট্রিম করেন। এসব ভিডিও স্ট্রিমে সংবাদও থাকে। পৃথিবীর সব কটি চালু পত্রিকার টুইটার পেজ আছে। সব মিলিয়ে গুগল, ফেসবুক, টুইটার আর ছোট কোনো কোম্পানি না। এ শতাব্দীর সবচেয়ে সফল ব্যবসাগুলোর মধ্যে আছে তারা।
জানালা খুললে খোলা বাতাস যেমন আসে, তেমনি ধুলো-ময়লা ঢোকার অবকাশও আছে বেশ। সেটাই ঘটছে। লোকে এখানে অনলাইনে উত্ত্যক্ত করছে অন্যদের। যথেচ্ছ রাজনৈতিক মিথ্যাচার সামাজিক মাধ্যমের কেতা হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে যোগ হচ্ছে অধুনা বর্ণবাদী রাজনীতিকদের আনাগোনা।
এসব অভিযোগের মুখে এই নিরপেক্ষতার দাবি ফাঁকা বুলির মতোই শোনায়। এখন আমরা এই সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর এলগরিদমের কারিকুরি বুঝি। আমরা জানি, এসব করে সামাজিক মাধ্যমগুলো তাদের কনটেন্ট পৌঁছে দিচ্ছে ভোক্তাদের কাছে। ভোক্তা কী দেখবেন, সেটি সামাজিক মাধ্যমের এলগরিদম ঠিক করে দেয়। ফলে মানুষের কাছে ‘বক্তব্য’ পৌঁছে দেওয়ার দায়ভার যেহেতু সামাজিক মাধ্যমের ওপরে আছে, মানুষের কাছে কী পৌঁছাচ্ছে, সেই দায় সামাজিক মাধ্যম এড়াতে পারে কি না, সেটা এখন প্রশ্ন।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রশ্নের জবাবে ফেসবুকের মিডিয়া প্রতিনিধি ইয়েইন ম্যাকেনজি বলেন, ‘ফেসবুকে এখন একদল মডারেটর নিযুক্ত আছেন এসব বিষয়ে নজরদারি করার জন্য। সব কটি পোস্টের সঙ্গে রিপোর্ট বাটন আছে।’
তবে এটুকুতেই আর সন্তুষ্ট থাকছে না বিশ্ব প্রশাসন। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাস হয়েছে এসইএসটিএ অ্যাক্ট। দ্য ইকোনমিস্টের মতে, এই আইনের মূল লক্ষ্য শিশু পর্নোগ্রাফির ওপর খড়্গহস্ত হওয়া। জার্মানি এ ব্যাপারে আরও এক কাঠি কড়া। যেকোনো ধরনের বর্ণবাদী, বিদ্বেষমূলক বাক্য সামাজিক মাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলার বেঁধে দেওয়া দিন-তারিখ আছে। নাৎসি জার্মানির ইতিহাস থেকে শক্ত শিক্ষা নিয়েছে জার্মানি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হোক, সেটি তারা চায় না।
এখানে প্রশ্ন চলে আসে দুটো। প্রথম প্রশ্নের রাজনৈতিক মোহনীয়তা আছে। বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতান্ত্রিক দেশগুলো অটল হলেও সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্টে বিধি–নিষেধ আরোপ করলে সেটা আদৌ স্বাধীন বাক্য থাকছে কি না?
তবে এ ব্যাপারে একমত নন মিশকন দ্য রেয়া প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী শার্লট হ্যারিস। গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জনপ্রিয়তা আর ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীলতার প্রশ্নও এসে হাজির হয়।’ তিনি মনে করেন, সামাজিক মাধ্যমগুলো বিভিন্ন বিপজ্জনক মতামত বা কনটেন্টের দায়বদ্ধতা এড়াতে চায়। তবে ‘কেউ আইন ভাঙলে তার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা হবে’—শুধু এটুকু বলে সামাজিক মাধ্যমগুলো পার পেতে পারে না বলেই শার্লট হ্যারিস মনে করেন।
অন্যটা পুরোটাই বাণিজ্যিক, তবে আলোচনা জরুরি। যখন এই সামাজিক মাধ্যমগুলো ছোট পরিসরে ছিল, তখন আইনের সাহায্যেই তারা নানা খরুচে মামলার হাত থেকে বেঁচে যেত এই দায় এড়িয়ে। এখন হয়তো ফেসবুক বা টুইটারের ব্যবহারকারী আছেন দুই বিলিয়নের ওপর, তারা এখন সেনেটের সঙ্গেও মামলা লড়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ফেসবুক বা টুইটার অথবা এখনকার অন্য সামাজিক মাধ্যমগুলোই তো শেষ কথা নয়। নতুন কেউ আসতে গেলে এসব নতুন দায়বদ্ধতার আইন তাদের ব্যবসায় ভাটা ফেলবে কি না, সেটি ভেবে দেখা জরুরি।
তিন নম্বরে আরও একটি সমস্যা দেখা যায়, অনলাইনে কী দেখতে পাবেন আর কী দেখতে পাবেন না, সেটি নির্ধারণ করছে হয় একটি এলগরিদম অথবা সিলিকন ভ্যালির ঘুপচিতে বসে থাকা সমমনা কিছু প্রোগ্রামার। এমন একদল ব্যক্তি নির্ধারণ করছেন আমরা কী দেখব, তাঁরা কম্পিউটারে অলিগলি চিনলেও রাজনীতি, মরালিটি ইত্যাদি নিয়ে সুদীর্ঘ বাহাস করার এলেম রাখেন কি না, সেটিও ভেবে দেখতে হবে।
সব মিলিয়ে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের বিশ্ব সংস্কৃতির ওতপ্রোত অংশ হয়ে গেছে। রাজনীতি, ভোট, এমনকি জ্ঞানের চর্চা—সবকিছুতেই মিশে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাতে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে। কোনো বিষয়ই আজকাল এক কলমের খোঁচায় খারিজ বা গ্রহণ করার অবস্থায় নেই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোরও নিজেদের খোলনলচে বদলানোর সময় এসেছে। স্রেফ কিছু এলগরিদম আর কিছু পলিসির ওপর ভিত্তি করে সামাজিক মাধ্যম চালালে বিপদ বাড়বে বৈকি। এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়েও গভীর ভাবনার সময় এসেছে।
ফাহাদ আল-আবদুল্লাহ: নৃবিজ্ঞানী