মতামত

কিশোর ত্বকী থেকে লেখক মুশতাক

৬ মার্চ এলে বর্বরতার অট্টহাসি কানে বাজে। কারণ, ২০১৩ সালের এই দিনে নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী অপহৃত হয়, তার দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর শাখাখাল থেকে উদ্ধার হয় তার লাশ। এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং সেসবের বিচার না পাওয়া মানুষের মিছিলে নতুন নতুন মুখ যোগ হয়েই চলেছে। ত্বকীর মতো সাগর-রুনি, তনুসহ আরও অনেকেরই খুনের বিচার হয়নি। গুম হওয়া অনেক মানুষের এখনো খোঁজ মেলেনি। আর এ বছর যোগ হলেন আরেকজন লেখক-উদ্যোক্তা—মুশতাক আহমেদ। খুনিদের কেউ কিছু করতে পারে না, তারা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জয়গান গাইতে থাকে, মুখোশের ভেতর থেকে তাদের বীভৎস হাসি বাংলাদেশকেই ব্যঙ্গ করতে থাকে। এ বছর এই বীভৎস হাসি আরও উচ্চকিত হলো। ত্বকীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দিন আসতে আসতেই এল মুশতাকের খবর।

ত্বকী পাঠাগারে পড়তে যাচ্ছিল। কয়েকজন পান্ডা এই কিশোরকে তুলে নিয়ে ক্রমাগত নির্যাতনে হত্যা করেছে, লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে ত্বকীর প্রিয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। ত্বকীর অপরাধ ছিল ও লিখত, গান গাইত, স্বপ্ন দেখত; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষের সমাজ গড়তে চেয়েছিল। ত্বকীর আরও অপরাধ, ওর বাবা রফিউর রাব্বি দখলদার-লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে জনস্বার্থে সরব। ত্বকী শুধু নয়, নির্যাতন, খুনের ঘটনা এদের নিয়মিত কাজ। ত্বকী খুনের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে জনপ্রতিবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে যাওয়ার মুখে তদন্ত হলো, প্রমাণাদিও পাওয়া গেল, শামীম ওসমানের পরিবারের সদস্য শনাক্ত হলো দায়ী হিসেবে। কিন্তু হঠাৎই সব প্রক্রিয়া থেমে গেল। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল। রফিউর রাব্বি এ বিষয়ে লিখেছেন, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ ত্বকী হত্যার তদন্তকারী সংস্থা র‍্যাব সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তদন্ত শেষ, প্রতিবেদন তৈরি, অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে। কিন্তু তারপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারণে ত্বকী হত্যার বিচারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

নানা রকম বাধাবিপত্তির মধ্যেও এ দেশে যতটুকু খবর প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকার–সমর্থিত বিভিন্ন বাহিনী নদী-বন দখল, সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে নিপীড়ন, হুমকি, হামলা, খুন, গুম চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সরকার একদিকে আইনবহির্ভূত জুলুম, যেমন: ক্রসফায়ার, হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা, ধরপাকড়, ভয়ভীতি, সভা-সমাবেশ বন্ধ, হুমকি-হয়রানি চালাচ্ছে, অন্যদিকে আইন-আদালতকেও ব্যবহার করছে লুট-খুন-জখমসহ নানা অন্যায়কে বৈধতা দেওয়ার জন্য। কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এ রকমই একটি জুলুমের আইন। এ আইন ব্যবহার করেই সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুলের শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, কার্টুনিস্ট, রাজনৈতিক কর্মী আটক করা হয়েছে। দেশের ভিআইপি লুটেরা-দখলদারদের নিরাপত্তার জন্য এ আইন মোক্ষম অস্ত্র, আর একই কারণে সর্বজনের জন্য এটি হলো ‘ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতা’ সৃষ্টিকারী আইন।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে তুলে নিয়ে বহুদিন পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল এক ভিআইপি দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার জন্য। ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র সদস্য দিদারুল ইসলাম যখন সরকারের করোনাকালের ত্রাণ বিতরণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করছিলেন, তখন তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মুশতাক-কিশোরদের ক্ষেত্রেও সরকারের তৎপরতা নিয়ে কার্টুন ও লেখা ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ফাহমিদুল হক তাঁর ফেসবুক পোস্টে পুরো পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ করেছেন এভাবে, ‘মুশতাক নয় মাস ধরে কারাগারে পচেছেন। মুশতাকের ক্ষেত্রে ছয়বার জামিন নাকচ হয়েছে। মুশতাক পচতে পচতে মরেও গেলেন। এতে কিছু লোক বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ করল, পুলিশ দিয়ে তাদের পেটানো হলো, কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলো, কয়েকজনকে বাসা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হলো।...এখানে আপনি বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান সব চরিত্র পাচ্ছেন: লুটপাটকারী ব্যবসায়ী, শিল্পীর বিদ্রূপ ও তার পরিণতি, নিপীড়িত জনগণ ও নির্দয় সর্বোচ্চ নির্বাহী।’

সরকারের পছন্দের মানুষ কারা আর কারা তাদের জন্য আতঙ্ক; কাদের সরকার পুরস্কৃত করে আর কাদের তারা তিরস্কার শুধু নয়, অবিরাম হয়রানি এমনকি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, তা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। শুধু শিক্ষকদের কথা বলি। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার আনন্দের সঙ্গে এমন এক লোককে উপাচার্য পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেছে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় পান না, আরও অনেক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই তরুণ একজন শিক্ষক দুর্নীতি নিয়ে কয়েকটি বাক্য লিখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পান্ডা বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তাঁকে পাঠিয়েছে জেলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য ফোনে অর্থ দাবি করছেন। সেই ফোনালাপ ফাঁসও হয়ে গেল, তাতে তেমন অস্থিরতা দেখা গেল না, কিন্তু একই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সরকারসমর্থক বলে পরিচিত একজন শিক্ষকই যখন মন্ত্রীর দুর্নীতির কথা বললেন, তখন তাঁকে ভরা হলো জেলে এই একই আইনে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককেও জেলে যেতে হয়েছিল একটা বাক্য লেখার জন্য। সরকার ও তার সহযোগীরা কথার উত্তরে কথায় বিশ্বাস করে না, লেখার উত্তরে লেখায় বিশ্বাস করে না। পছন্দ না হলে কথা আর লেখার জন্যই তারা মানুষের জীবনের ওপর হামলা চালায় উগ্রবাদীদের মতো।

ত্বকী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথাই বলা শিখেছিল, সেই চেতনা নিয়েই রফিউর রাব্বিসহ জনপন্থী লেখক, শিল্পী ও সংগঠকেরা ত্বকী হত্যার প্রতিবাদ জারি রেখেছেন এখনো। আর এ হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিরা একদিকে দখল-লুণ্ঠনের সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত করে প্রতিবাদীদের ওপর অবিরাম হয়রানিতে লিপ্ত। জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ নয়, তার বিরোধী লোকজনকে রক্ষা করতেই সরকারের আগ্রহ ও উদ্যোগ বেশি।

বাংলাদেশে দুর্নীতি, বন-নদী দখল, খুন, সন্ত্রাস, ক্রসফায়ার, মানুষের অধিকার হরণ—কোনো কিছুই সরকার স্বীকার করে না। আত্মসন্তুষ্টি, নিজের ঢোল পেটানো আর সত্য অস্বীকার সরকারের বড় বৈশিষ্ট্য। দেশের সংবাদমাধ্যম যা প্রকাশ করতে পারে না, তার কিছু কিছু বিদেশের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে তারা আর নতুন কী খবর দেবে? আমরা তো চোখের সামনেই দেখছি নদীর পর নদী নর্দমা হচ্ছে বা দখল হচ্ছে, সুন্দরবন থেকে শুরু করে সব বন দখল আর বিনাশে তৎপর চেনা গোষ্ঠী; প্রাণঘাতী ও পরিবেশঘাতী প্রকল্প পাস হচ্ছে একের পর এক। সব প্রকল্পের ব্যয় বিশ্বের সব দেশের চেয়ে বহু বেশি। অতি ব্যয় হলেও সড়ক-সেতু-ভবন ভেঙে পড়ছে, ব্যাংকগুলো লোপাট হচ্ছে, প্রতিবছর কমপক্ষে চারটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাচ্ছে। ভয়ভীতি জারি না রেখে এগুলো চালানো কি সম্ভব?

খুন, জুলুম, দূষণ, লুণ্ঠনের মতোই অসত্য বিজ্ঞাপনী প্রচার ও মিথ্যা মামলাতেও সরকার রেকর্ড করছে। পুলিশ হেফাজতে মুশতাক খুনের প্রতিবাদ করার কারণেই প্রতিবাদ মিছিলে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে অনেককে। এই হামলা ও খুলনায় বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর রুহুল আমিন, জয়সহ আটজনের বিরুদ্ধে জুলুম-মিথ্যা মামলা চাপানো হয়েছে। আসলে সরকারের এসব অপতৎপরতা থেকেই তার দায় স্পষ্ট হয়। তবে এসব হামলা-মামলা করে কোনো লাভ হয় না, ভয়ংকর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ থামে না। ত্বকীর সঙ্গে সঙ্গে সাগর-রুনি-তনু-মুশতাকেরা তাই আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকেন।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

anu@juniv.edu