পাড়ার গলি, স্কুল-কলেজ গেট অথবা কোনো উদ্যানে ১১-১২ থেকে ১৬-১৭ বছরের দলবদ্ধ কিছু কিশোর দেখা যায়, যাদের চাহনিতে আছে রুক্ষতা, নেই নম্রতা-ভদ্রতার ছাপ। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি অথবা মোটরসাইকেলের বিরক্তিকর হর্ন বাজিয়ে প্রকাশ্যে মানুষকে উত্ত্যক্ত করা তাদের কাজ। সংঘবদ্ধ হয়ে বিশেষত কিশোরী কিংবা নারীদের তারা প্রায়ই উত্ত্যক্ত করে। এই ধরনের চক্র এখন সমাজের ব্যাধির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের আমরা ‘কিশোর গ্যাং’ নামে চিনি।
এই বখাটে কিশোর গ্যাং কারা? কী তাদের পরিচয়? এদের কি মা-বাবা, ভাইবোন, সমাজ-সংসার নেই? তাহলে এদের জন্ম কোথায়? কোন বাড়িটায় ঘুমায় ওরা? কারা তাদের মদদদাতা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলেই এই হিংস্র কিশোর গ্যাং দমন সহজেই সম্ভব বলে মনে করি। সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ এই কিশোর গ্যাং নির্দ্বিধায় একের পর এক অন্যায়, ত্রাস, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের মতো বড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে শুধু তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে বলে। প্রচলিত আইনে ১৮ বছরের নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বড় কোনো শাস্তির পরিবর্তে তাদের পাঠানো হচ্ছে গাজীপুরে অবস্থিত কিশোর শোধনাগারে। সেখান থেকে কি এই অপরাধী কিশোরেরা আলোকিত মানুষ হিসেবে বের হচ্ছে। উত্তরটি প্রশ্নবিদ্ধ। তাই প্রয়োজন আইনটির সংস্কার।
মনে পড়ে ১৯৯০ সালের কথা, যখন আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল অন্নদা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। একদিন সাইকেল নিয়ে বাইরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বাড়িতে বিচার চলে এল। শুধু মায়ের তীক্ষ্ণ চাহনিতেই বুঝেছিলাম শৃঙ্খলার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এখন এই বয়সের কিশোরেরা মা-বাবার সঙ্গে তর্কে জড়াচ্ছে। মা-বাবাকে খুনের ঘটনাও এখন মামুলি। কী কারণ এই নব্য অশান্তির? কোথা থেকে নৈরাজ্য শিখেছে কিশোর গ্যাং? কারা এদের মদদদাতা?
আমার মনে হয়, স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এই গ্যাং আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়েছে। এর পেছনে আরও কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়।
সামাজিক যোগাযোগের দোহাইয়ে যারা অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত, তাদের ওপর কঠোর নজরদারি এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে ফেসবুকের অপব্যবহার করে এসব চক্র যেসব অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে তা ঠেকাতে হলে কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দরকার। এ ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
কিশোর গ্যাং’ দমনে পরামর্শ
১. র্যাবের প্যাট্রোল জিপগুলো সর্বক্ষণিক টহলে থাকবে। যেখানেই কিশোর গ্যাংয়ের অনাচার দেখবে, তাদের হাতেনাতে ধরে স্থানীয় র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের জীবনবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করে তাদের প্রকৃত অভিভাবককে (মা-বাবা) ডেকে তাঁদের সন্তানদের বিপথগামিতার কারণ উল্লেখপূর্বক সতর্কতার বার্তা দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশেষ বিবেচনায় মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে তাদের তুলে দেওয়া যেতে পারে।
আটক কিশোরদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে যদি কোনো সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিক নেতার নাম পাওয়া যায়, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। গণমাধ্যমে কিশোরদের প্রশ্রয়দানকারী ওই সব অসাধু মানুষের পরিচয় ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
২. দ্বিতীয়ত, মুচলেকা প্রদানকারী ওই সব কিশোরদের যদি দ্বিতীয়বার একই অপরাধে পাওয়া যায়, তাহলে র্যাব প্যাট্রোলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার তাদের আটক করে র্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সে ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবককে জানানোর বিষয়টির আর গুরুত্ব পাবে না।
৩. সাঁড়াশি অভিযানের লক্ষ্যে সারা দেশে র্যাবের ব্যাপ্তি আরও জোরদার এবং ইউনিট বাড়ানোর ব্যাপারে জোর দাবি জানাচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ভৈরবে অবস্থিত র্যাবের কোম্পানিকে অবহিত করা সাপেক্ষে অনেক সময় পরে সেখানে র্যাব পৌঁছায়। তাহলে র্যাপিড অ্যাকশন কিন্তু হচ্ছে না। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে র্যাবের পৃথক কোম্পানি স্থাপন করতে হবে। এটি একটি উদাহরণ। এমনিভাবে সারা দেশে তিন মাসের একটা ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হাতে নেওয়া যেতে পারে।
সাধারণভাবে ‘ওরা পোলাপান’ বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ইতিমধ্যে বড় বড় অঘটন বখাটে কিশোরেরা ঘটিয়ে ফেলেছে। আর ছোটভাবে দেখার সুযোগ নেই। এখনই ব্যবস্থা না নিলে সমাজ অস্থির হয়ে উঠবে।
ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।