ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে ছিনিয়ে নিয়েছে, যা বিতর্কিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটিকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল এবং একে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে (রাজ্যগুলোর নিচে মর্যাদায়) বিভক্ত করেছে, যেখানে সরকার আরও প্রত্যক্ষভাবে শাসন পরিচালনা করতে পারবে। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। সাত দশক আগে সদ্য স্বাধীন ভারতে এর প্রয়োজন ছিল। এখন এই বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নিয়ে ভারত সরকার এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিপন্ন করেছে।
মোদি সরকার খুব ভালো করেই জানে যে এই পদক্ষেপটি কাশ্মীর ও পাকিস্তান ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণার আগের কয়েক দিনে সরকার এই অঞ্চলে অতিরিক্ত ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করে। পদক্ষেপ ঘোষণার পর সরকার কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ওপর কারফিউ চাপিয়েছে; পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের সরিয়ে নিয়েছে; স্থানীয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের (যাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছিলেন) গৃহবন্দী করে রেখেছে এবং গোটা রাজ্যে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
পাকিস্তান ইতিমধ্যে স্পষ্টভাবেই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে একে অবৈধ বলে উল্লেখ করেছে এবং এর মোকাবিলায় ‘সম্ভাব্য সব বিকল্প প্রয়োগ’ করার অঙ্গীকার করেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতাসম্পন্ন এই দুটি দেশের মধ্যে আরেকটি সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কাশ্মীর সংকটের সমাধান কেন এত কঠিন, তার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। আর এই তিনটি কারণে গোটা বিষয়টি ভারতের নিজের পক্ষে নেওয়ার একতরফা চেষ্টার কাজ না-ও করতে পারে।
প্রথম কারণটি পরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে ভাগ করার সময় কাশ্মীরের মতো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অবস্থান কী হবে, তা না বলে দেওয়ায় কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়, যা আজও বর্তমান। একদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় রাজ্যটির অস্তিত্ব এই উপমহাদেশের সব মুসলমান পাকিস্তানে থাকবে, এই ধারণাটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে ভারত তার একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যকে হারালে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসেবে এর মূল পরিচয় ক্ষুণ্ন হবে এবং এর অবশিষ্ট ১৮ কোটি মুসলমানকে অরক্ষিত করবে।
ভারত ভাগের সময় কাশ্মীরের তৎকালীন শাসকেরা ভারতের সঙ্গে থাকতে চাইলেও তারা ভারতের অঙ্গীভূত হয়নি। তারা প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়াদি এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাদের স্বায়ত্তশাসনকে সুরক্ষিত করে। ১৯৫৪ সালে ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত হওয়া ৩৫-এ অনুচ্ছেদে, কাশ্মীরি নাগরিকদের সম্পত্তির মালিকানা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিশেষ অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ ছিল।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ বলে পাকিস্তানের দাবি করা। আর এ দাবির কারণে প্রায়ই সীমান্তে উভয় দেশের সেনাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে থাকে। পাকিস্তান জানে যে ভারতের সঙ্গে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ হলে তারা যুদ্ধে হারবে। আর ভারত জানে যে লড়াইয়ের ময়দানে তারা পাকিস্তানকে হারাতে পারবে, তবে তা পাকিস্তানের আন্তসীমান্ত আক্রমণ পুনরায় শুরু করার ক্ষমতাটিকে নষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
সবশেষে ভারত তার নিজেরই তৈরি করা নীতিমালা কারাকক্ষে আটকা পড়েছে। ভারতীয় ভোটারদের কাছে সরকার বলে বেড়িয়েছে যে এখানে কোনো বিরোধ নেই। তারা জোর দিয়ে বলেছিল যে কাশ্মীর ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই কোনো আলোচনার দরকার নেই।
ভারতীয় নেতারা বিশ্ববাসীকে এটা বুঝিয়েছেন যে যেসব জিহাদি গোষ্ঠী ভারতে সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তাদের সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই কাশ্মীর সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনার যেকোনো উদ্যোগ তাঁরা নাকচ করে দেন। এখন ধর্মীয় গোঁড়ামির পাশাপাশি বিজেপি সরকারের কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তির মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, পাকিস্তান-সমর্থিত জিহাদি গোষ্ঠীগুলো ভারতীয় কাশ্মীরে হাইব্রিড যুদ্ধ পরিচালনা করছে। এমনিতে পাকিস্তানের ওপর ভারতের প্রতিশোধমূলক সামরিক হামলা এবং পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত বৃদ্ধি কাশ্মীরকে বারুদের বাক্সে পরিণত করেছে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়ার ভারতের সিদ্ধান্ত এই বারুদের বাক্সে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঘটাতে পারে।
এই বিপজ্জনক নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ভারতের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে একমত হয়ে দুই দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমান্তকে খুলে দিয়ে একটি উন্মুক্ত স্থানে রূপান্তরিত করা। যার মধ্য দিয়ে ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
রমেশ কুমার ঠাকুর: জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব