কাশ্মীরে পুরোনো উপদ্রব নতুনভাবে ফিরে এসেছে। অমুসলিম নাগরিকেরা হত্যার শিকার হচ্ছেন
কাশ্মীরে পুরোনো উপদ্রব নতুনভাবে ফিরে এসেছে। অমুসলিম নাগরিকেরা হত্যার শিকার হচ্ছেন

কাশ্মীরে গৃহত্যাগের নব অধ্যায়, ভবিষ্যৎ অজানা

দেশজোড়া উৎসবের আবহে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর হুংকার, ‘সীমান্ত সন্ত্রাস না কমলে ভারত প্রয়োজনে আরও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হানবে।’ কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে (যার বলি একাধিক ভারতীয় সেনা ও হিন্দু-শিখ নাগরিক) এই হুংকার রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু তাতে উপত্যকার পরিস্থিতি আদৌ বদলাবে কি না, সে প্রশ্ন আরও একবার নতুনভাবে উঠে আসছে। তিন দশক আগে অশান্তির যে বীজ বপন করা হয়েছিল, কালের নিয়মে যা মহিরুহ, আজও তা বিষফল উৎপাদন করে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় প্রচেষ্টা অবজ্ঞা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি নতুন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ভারতের পরাক্রমকে!

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই নবহুংকারের প্রেক্ষাপট শুধু কাশ্মীর মনে করলে ভুল হবে; কাশ্মীরে অবশ্যই পুরোনো উপদ্রব নতুনভাবে ফিরে এসেছে। অমুসলিম নাগরিকেরা হত্যার শিকার হচ্ছেন। সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষ হচ্ছে নিত্য। সরকারের গরিমা নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। গত তিন বছরের পরিকল্পিত পরিশ্রম নিছকই পণ্ডশ্রম কি না, বিব্রতকর সে প্রশ্নও উঠছে। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্কের। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। এবার থেকে পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও বিএসএফ সীমান্তের ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় তল্লাশি চালাতে পারবে, আগে যা ছিল ১৫ কিলোমিটার। এর ফলে পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তের সব রাজ্যে বিএসএফকে ঢাল করে কেন্দ্রীয় সরকার তার খবরদারির এলাকা প্রসারিত করল ‘দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে’। এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও নড়বড়ে করে দেবে—এ আশঙ্কায় বিরোধীরা প্রতিবাদে মুখর। জাতীয়তাবাদ জাগানোর জন্য অতএব কিছু একটা ঘোষণা জরুরি ছিল। অমিত শাহর কণ্ঠে তাই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নতুন হুংকার।

কিন্তু তাতে কাশ্মীর উপত্যকার হাল ফিরবে কি? সন্দেহ তা নিয়েই। কারণ, ৩২ বছর পর উপত্যকা থেকে আরও একবার বইতে শুরু করেছে উদ্বাস্তুস্রোত। কাশ্মীর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। সরকারকে বিশ্বাস করে তাঁরা উপত্যকায় থিতু হতে চেয়েছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন, এত কাঠখড় পোড়ানো সত্ত্বেও তো সেই ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়!’

উপত্যকা থেকে হিন্দু ও শিখ উচ্ছেদ পর্বের শুরু ১৯৮৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন শ্রীনগরের পরিচিত আইনজীবী টিকালাল টাপলু নিজ গৃহে খুন হন। ৪ নভেম্বর খুন হন হাইকোর্টের বিচারপতি নীলকান্ত গঞ্জু, যিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মকবুল বাটকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। ডিসেম্বরে অপহৃত হন দেশের প্রথম মুসলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সাইদের মেয়ে রুবাইয়া। উপত্যকার প্রথম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) সেই প্রথম আন্তর্জাতিক পরিচিতি প্রাপ্তি। সংগঠনের পাঁচ সদস্যের মুক্তির বিনিময়ে উদ্ধার পেয়েছিলেন রুবাইয়া। প্রবল উৎসাহিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে দিল হিন্দু বিতাড়ন অভিযান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত যে উপত্যকায় খুন ছিল বিরলতম ঘটনা, সেখানে শুরু হলো রক্তের হোলি। আজ যা নৈমিত্তিক ঘটনা!

টানা তিন বছরের বেশি জম্মু-কাশ্মীর রাজনীতিবিবর্জিত। দুই বছর আগে কাশ্মীর তার গরিমা হারিয়েছে। রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। প্রত্যাহৃত হয়েছে সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা। কেন্দ্র যা ঠিক মনে করছে, তিন বছর ধরে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা পর্যন্ত বিবেচিত হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টে! সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার রূপায়ণে এই বাধাহীনতা সত্ত্বেও কাশ্মীর ফেরেনি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে।

গত ৩২ বছরে কত হিন্দু-শিখ কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে অন্যত্র ঘাঁটি গেড়েছেন? সংখ্যাটা সাড়ে তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে। বেশির ভাগ গেছেন জম্মু ও দিল্লি। অন্যরা উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে। কেউ কেউ বিদেশে। নতুন শতকের গোড়ায় বদগাম জেলার শেখপুরায় কাশ্মীরি হিন্দুদের নিরাপত্তাবলয়ে রাখা শুরু হয়। ক্রমেই বিভিন্ন জেলায় তৈরি হয় এমন কিছু ঘেরাটোপ। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরাতে সরকারি চাকরি ও নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। এই বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৩ হাজার ৮৪১ জন গৃহত্যাগী উপত্যকায় ফিরে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে চাকরি নেন। কিন্তু নতুন করে অমুসলমানরা হত্যার শিকার হওয়ায় শয়ে শয়ে হিন্দু-শিখ উপত্যকা ছাড়তে শুরু করেছেন। প্রশাসন ও দিল্লির শাসকদের আস্থা তাঁদের কাছে বালুর বাঁধ। তাঁরা নির্দ্বিধায় বলছেন, ঘেরাটোপের বাইরে বেরোলেই জীবনহানির ঝুঁকি। এভাবে বাঁচা সম্ভব নয়। নতুন গৃহত্যাগীদের অধিকাংশই সরকারি চাকুরে। আছেন শিক্ষক ও ব্যবসায়ীরাও।

তিন দশক আগে গৃহত্যাগীদের পরবর্তী প্রজন্ম উপত্যকায় ফিরতে নারাজ। অগ্রজদের মতো স্মৃতিমেদুরতায় ভুগতে তাঁরা প্রস্তুত নন। স্বস্তি ও জীবনের নিরাপত্তা তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উপত্যকায় টিকে থাকা অথবা সরকারি আশ্বাসে ফিরে যাওয়া মানুষ আবার পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থেই নতুন করে উদ্বাস্তুজীবন আবাহন করছেন। এ উপাখ্যান এক অদ্ভুত চক্র!

টানা তিন বছরের বেশি জম্মু-কাশ্মীর রাজনীতিবিবর্জিত। দুই বছর আগে কাশ্মীর তার গরিমা হারিয়েছে। রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। প্রত্যাহৃত হয়েছে সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা। কেন্দ্র যা ঠিক মনে করছে, তিন বছর ধরে তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। সরকারি সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা পর্যন্ত বিবেচিত হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টে! সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার রূপায়ণে এই বাধাহীনতা সত্ত্বেও কাশ্মীর ফেরেনি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে।

তিন বছরে উপত্যকায় একটাও নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। অবাধ রাজনীতি শৃঙ্খলিত। সর্বত্র আমলাশাহির রমরমা। অভিবাসী নীতির বদল কাউকে এখনো উৎসাহিত করে তোলেনি। গৃহত্যাগীরা ঘরে ফেরেননি; বরং শুরু হয়েছে গৃহত্যাগের নতুন স্রোত। কাশ্মীরের ভাগ্যে কী আছে, কেউ জানে না।

যদিও সরকারি দাবি, কাশ্মীর শান্ত। সেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। মানুষ খুশি। এত বছর ধরে রাজনীতি করে আসা পরিচিত পরিবারগুলো (আবদুল্লাহ, সাইদ, গান্ধী) পরিত্যাগ করে মানুষ নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। অথচ কী আশ্চর্য, শাসক বিজেপি ও তাদের মদদে তৈরি ‘আপনি পার্টি’কে উপেক্ষা করে জেলা উন্নয়ন বোর্ডের ভোটে সিংহভাগ আসন জিতল প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর জোট ‘গুপকর অ্যালায়েন্স’, যারা রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণ ও মর্যাদাহানির বিরুদ্ধে সরব। সন্ত্রাসীদের হুমকিতে পদত্যাগ করছেন একের পর এক বিজেপি নেতা ও পঞ্চায়েতপ্রধানেরা। খুনও হচ্ছেন। শাসক-অনুগত ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’-এর পরিসংখ্যানেও প্রতিষ্ঠিত নয় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি। তাদের হিসাবে গত তিন বছরে নাগরিক ও নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ২৩০টি, বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর ৩৬৩ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে, নিহত হয়েছে ৩৯৩ জন, সন্ত্রাসীদের ৫৭টি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে। শুধু এই বছরের হিসাব নিলে ধৃত ১৭১ সন্ত্রাসবাদী, ১২০টি চক্রান্ত বানচাল হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে ২৭টি জঙ্গিঘাঁটি।

হিংসা অব্যাহত থাকলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় কী করে? প্রশ্নটি উঠছেও। আফগানিস্তানের পালাবদলের পর গোয়েন্দা হুঁশিয়ারি ও সরকারি স্বীকারোক্তিতেও অদ্ভুত মিল, ‘আগামী দিনে উপত্যকার পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।’ কারণ, ‘আফগানিস্তানে তালেবান শাসন পাকিস্তানকে দ্বিগুণ উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করেছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নতুন জাতীয়তাবাদী হুংকারের কারণ ও পরিপ্রেক্ষিত অতএব সহজেই অনুমেয়।

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সময় রাজ্যসভার বিতর্কে কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ৭০ বছর ধরে কাশ্মীরি জনতার এক বিরাট অংশ মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সংবিধানের প্রতি তারা বিশ্বস্ত। প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিটি সংঘাতে এই জনগোষ্ঠী ভারতীয় বাহিনীকে সক্রিয় মদদ দিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এরাই হয়ে উঠেছে এক দুর্ভেদ্য ‘বাফারজোন’। রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণ ও বিশেষ মর্যাদা খারিজের সিদ্ধান্ত সেই সমর্থন খোয়ানোর আশঙ্কা জোরালো করে তুলবে। কাশ্মীরি গুলাম নবীর অনুরোধ ছিল, সরকার যেন এ হঠকারিতা না করে।

তিন বছরে উপত্যকায় একটাও নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। অবাধ রাজনীতি শৃঙ্খলিত। সর্বত্র আমলাশাহির রমরমা। অভিবাসী নীতির বদল কাউকে এখনো উৎসাহিত করে তোলেনি। গৃহত্যাগীরা ঘরে ফেরেননি; বরং শুরু হয়েছে গৃহত্যাগের নতুন স্রোত। কাশ্মীরের ভাগ্যে কী আছে, কেউ জানে না।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি