৭ জানুয়ারি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে ২০২০-২১ অর্থবছরের ছয় মাসে ১০ হাজার কোটির বেশি কালোটাকা সরকারঘোষিত ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করা হয়েছে এবং এর ফলে অর্থনীতিতে বিরাট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, এই তথ্য সরকারের নীতির যথার্থতার প্রমাণ। সৎ করদাতা ১৫-২৫ শতাংশ কর দেবেন আর কালোটাকার মালিক ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাঁর কালোটাকা সাদা করতে পারবেন, এই নীতি কখনো সঠিক হতে পারে না। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত যে বছরের পর বছর ১০ শতাংশের নিচে রয়ে যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরকারের এই অনৈতিক নীতি।
অতএব অর্থমন্ত্রীর এই দাবি সমর্থনযোগ্য নয়। এ বছর বেশি কালোটাকা সাদা হওয়ার প্রকৃত ব্যাখ্যা হলো, করোনা মহামারি আঘাত হানার পর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার অনেকখানি বিঘ্নিত ও শ্লথ হয়ে যাওয়ায় কালোটাকার মালিকেরা তাঁদের অর্থের একাংশ ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করে কালোটাকা দেশের রিয়াল এস্টেট, অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়, শেয়ারবাজার ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করছেন। যেহেতু কালোটাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তাই এসব খাতে বিনিয়োগে বিপদ থাকছে না। মহামারি আঘাত হানার পর ছয় মাস ধরে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সপ্রবাহে যে ঢল নেমেছে, সেটাও প্রমাণ করছে যে গত বছরের মার্চ থেকে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচার শ্লথ হয়ে পড়েছে।
২০১৯ সালের ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ১৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এই অভূতপূর্ব রেমিট্যান্সের জোয়ার দেশের অর্থনীতিকে মহামারির নেতিবাচক অভিঘাত থেকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মহামারি মোকাবিলায় সবচেয়ে সফল দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বের যে গুটিকয় দেশ করোনা মহামারির বজ্রাঘাত সত্ত্বেও চলতি বছর ইতিবাচক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখতে পেরেছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে তৃতীয় সফলতম। দেশের শেয়ারবাজারের গত ছয় মাসের প্রশংসনীয় তেজিভাবের পেছনেও পুঁজি পাচার শ্লথ হওয়া মূল ভূমিকা পালন করছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কালোটাকার মালিকদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে সরকার কালোটাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে না। প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা হলো, ইতিমধ্যেই সৃষ্ট কালোটাকাকে ‘মেইন স্ট্রিমে’ নিয়ে আসা প্রয়োজন। নইলে নাকি এই টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। দুঃখের সঙ্গে তাঁকে জানাতে হচ্ছে, তাঁর সরকারের এ রকম উদ্যোগগুলো আদতে পুঁজি পাচার শ্লথ করতে পারবে না।
করোনা মহামারি আঘাত হানার আগের ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা (৭৫ বিলিয়ন ডলার) বিদেশে পাচার হয়েছে বলে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি’র গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। করোনা মহামারি পুঁজি পাচারকে সাময়িকভাবে শ্লথ করে দেওয়ায় অর্থনীতি হয়তো এর সাময়িক সুফল ভোগ করছে, কিন্তু দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত কা বাত’ বানিয়ে ফেললে মহামারি নিরসনের পর আবারও পুঁজি পাচার চাঙা হতে মোটেও দেরি হবে না।
আমার মতে, কালোটাকাকে ‘কর প্রদানের সময় অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞা দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই গুরুতর অপরাধটিকে যেভাবে হালকা করছে, তা সংবিধানসম্মত কি না, সে প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়। কারণ, দেশের সংবিধানের ২০(২) ধারা বলছে,‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’
প্রতি বাজেটে কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থার আসল মরতবা হলো প্রধানত দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিবিদদের জন্য সম্ভাব্য দুর্নীতি দমনের জাল থেকে পলায়নের একটি পথ খুলে দেওয়া। তাহলে দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কি নেহাতই ‘রাজনৈতিক স্ট্যান্ট?’ আমাদের নীতিপ্রণেতারা কি জানেন না সামান্য কিছু অর্থ এসব দুর্নীতিবাজ ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিলে ওই বৈধকরণের নথিপত্রগুলো তাঁদের হাজার হাজার কোটি কালোটাকা নিরাপদে রেখে দেওয়ার ভালো দালিলিক সুরক্ষা প্রদান করে থাকে, কারণ টাকার গায়ে তো কালো-সাদা লেখা থাকে না।
আমার মতে, কালোটাকাকে ‘কর প্রদানের সময় অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞা দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই গুরুতর অপরাধটিকে যেভাবে হালকা করছে, তা সংবিধানসম্মত কি না, সে প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়। কারণ, দেশের সংবিধানের ২০(২) ধারা বলছে,‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ সংবিধানের এই বিধানমতে ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালোটাকা হয় তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কালোটাকার সংজ্ঞা ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ দিতে পারে কি? এনবিআরের এই সংজ্ঞা দুর্নীতির সঙ্গে কালোটাকার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে, সেটাকে গৌণ বা লঘু করে দিচ্ছে।
অনস্বীকার্য যে অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত অর্থের ওপর ধার্য কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা সমাজে গেড়ে বসে থাকে। যেমন জমিজমা, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, দোকান, ইত্যাদি রিয়াল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রকৃত দাম না দেখিয়ে কম দাম দেখালে রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্টাম্প খরচ, সম্পদ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়। অতএব প্রায় সব ক্ষেত্রে এগুলোর মাধ্যমে কালোটাকার জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কালোটাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বলাই সংগত। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণাকারী সরকারের প্রধান টার্গেট তো হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থ-বিত্তকে কালোটাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে, সেটাকেই সাংবিধানিকভাবে আমার কাছে বেশি যৌক্তিক মনে হয়। এই সংজ্ঞা মোতাবেক মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং মুনাফাবাজ, কালোবাজারি, চোরাকারবারি, ব্যাংকঋণ লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অপরাধী সাব্যস্ত করা গেলে তাঁদের আইনের আওতায় এনে অপরাধের শাস্তিবিধান না করা হলে সেটা গুরুতর অসাংবিধানিক পদক্ষেপ হবে না?
অনেক দেশের সাম্প্রতিক নজির থেকে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অবস্থানে অতীতে যেসব দেশ ছিল সেগুলো বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন কিংবা নির্বাচনী পালাবদলের মাধ্যমে তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর উন্নয়নের মহাসড়কে শামিল হতে পেরেছে। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি বিবেচনা করলে এর সত্যতা মিলবে। সত্তরের দশক পর্যন্ত হংকং কালোটাকাকে সাদা করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু আশির দশকে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের পর হংকংয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ থেকে মুক্তি অর্জনের পর দুই দশকে তারা সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে অনেকখানি কমিয়ে আনতে সমর্থ হওয়ায় এখন ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নের পালেও প্রবল হাওয়া লেগেছে।
সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, দুর্নীতিজাত কালোটাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না।
এরশাদ আমলের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে বাড়তে তখনকার সাড়ে ৪ বা ৫ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছালেও এই প্রবৃদ্ধির সুফল প্রধানত কয়েক হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে। সে জন্যই মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল—এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তিদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ণয় করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়ছে না। বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে তাঁদের অতীতের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন না করে বরং এখন দেশের অর্থনীতি পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। উন্নয়ন অর্জনে সফল হওয়ার পরও আয় ও সম্পদবৈষম্য কমে না—টমাস পিকেটির সাড়া জাগানো গবেষণাগ্রন্থ ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির এই তত্ত্ব কী বলছে? সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, দুর্নীতিজাত কালোটাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। অতএব কালোটাকা সৃষ্টির বাস্তবতাকে প্রতিরোধে শামিল হওয়াই সময়ের দাবি। কালোটাকা সাদা করার মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা না করাই সমীচীন মনে করি।
অর্থমন্ত্রীর দাবি সংগত নয়, কালোটাকার লালন অনৈতিক, অসাংবিধানিক ও চরম ক্ষতিকর।
মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।