সম্প্রতি মিয়ানমারে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিককে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সরকারের তরফে অভিযোগ ছিল, তাঁরা ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ করে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রকাশ করেছেন; আর দণ্ডপ্রাপ্ত সাংবাদিকেরা বলছেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁরা আসলে ‘পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন’। কিন্তু পুরো পৃথিবীর প্রতিবাদ উপেক্ষা করে মিয়ানমার রাষ্ট্রের কালো আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের শাস্তি দিয়েছে।
সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে আমরা মনে করি, সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে বাংলাদেশেও মিয়ানমারের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটবে। কেন এই আশঙ্কা? আমরা কি ভুলে গেছি, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় কত সাংবাদিক এবং সাধারণ নাগরিক হয়রানির শিকার হয়েছেন! এ বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট মামলা হয়েছে ৩৯১টি। ওই সব মামলার বেশির ভাগই হয় ৫৭ ধারায়। এসব মামলায় আসামি ৭৮৫ জন, যাঁদের ৩১৩ জন গ্রেপ্তার হন। এই সময়ে ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয়। আমরা দেখেছি, এ আইনের অপব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; সর্বশেষ ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম ছাত্রলীগের এক নেতার মামলায় কারাগারে আছেন।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই অভিযোগে শুরু থেকেই তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখে সরকার থেকে এর আগে বলা হয়েছে, এটি বাতিল করা হচ্ছে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, ওই ধারাটির বক্তব্য বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের ভিন্ন ভিন্ন ধারায় রাখা হয়েছে। জনগণের সঙ্গে এই প্রতারণা কেন?
বারবার বলা হয়েছিল, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই নতুন আইন করা হবে এবং চূড়ান্তকরণের আগে সংশোধনের সুযোগ থাকবে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি; সাংবাদিকসহ অংশীজনদের আপত্তি উপেক্ষা করেই পাস হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল। জাতীয় সংসদে আইনটি উত্থাপনের পর দেখা যায়, এতে লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এমনকি ‘ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি’-বিষয়ক ৩২ ধারার মতো আরও কঠিন এবং বহুল আলোচিত, বিতর্কিত ও নিন্দিত একটি ধারা এতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিক, অধিকারকর্মীসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ কেন এই আইনের বিরোধিতা ও আইনটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তা আইনটির বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো বিবেচনায় নিলেই বোঝা যাবে।
৩২ ধারামতে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা; ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৪৩ ধারার মূল বিষয়বস্তু পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার। এ আইনের উপধারা-১-এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করে নিম্নবর্ণিত কার্য সম্পাদন করতে পারবেন:
ক) ওই স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ;
খ) ওই স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ;
গ) ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি;
ঘ) ওই স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার।
এ ছাড়া হ্যাকিং, কম্পিউটারের সোর্স কোড ধ্বংস ও সরকারি তথ্য বেআইনিভাবে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করে থাকছে নানা শাস্তি ও জরিমানার বিধান।
নতুন আইনের বেশির ভাগ ধারাই জামিন অযোগ্য। তবে এর মধ্যে মানহানির ২৯ ধারাসহ ২০, ২৫ ও ৪৮ ধারার অপরাধে জামিনের বিধান আছে। আইন বাস্তবায়নে থাকছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি। আর তদারকিতে থাকবে উচ্চপর্যায়ের ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল। এর প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী।
এই আইনের ধারাগুলোতে চোখ বোলালে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এখানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হচ্ছে। সে উপলব্ধি থেকে সম্পাদক পরিষদ এ আইনের ২১, ২৫, ২৮,৩ ১, ৩২ ও ৪৩—এই ছয়টি ধারা সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছে। তাঁরা দাবি করেছেন, নতুন আইনটির, বিশেষ করে এ ছয়টি ধারা সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল আইন হিসেবে পাস না করতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) আহ্বান জানিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বিলটির বিভিন্ন ধারার ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্বেগ ও মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা তাঁদের স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া ধারাটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং যেকোনো ধরনের গবেষণামূলক কর্মকাল পরিচালনার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে।
আমরা মনে করি, সরকারঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিশ্চিতের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনটি সে ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে। মত, দ্বিমত এবং ভিন্নমতের সম্মিলন ছাড়া সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় না। আর গণতন্ত্রকে শ্বাসরোধ করলে সেটি স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়, যা কখনোই একটি দেশের জন্য কল্যাণকর নয়।
আমরা আশা করতে চাই জনগণের বাক্স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়—এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার কার্যকর করবে না। তাই কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসহ (সিপিজে) অন্যরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন জানিয়েছেন, সেই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আমরাও আশা করছি, তিনি (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) এতে সই করবেন না, তিনি এমন ‘কালো আইনের’ অনুমোদন দেবেন না।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জয় হোক, গণতন্ত্রের জয় হোক।
রোবায়েত ফেরদৌস, মাহ্বুবুল হক ভূঁইয়া, কাজী আনিছ, এম মাহবুব আলম, নাসরিন আক্তার, সাহস মোস্তাফিজ, মাহমুদা আক্তার, রিফাত সুলতানা ও সজীব সরকার: লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক