কামিলার চোখে জল ও খেলার জগতের অন্ধকার কিছু দিক

পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে কামিলাকে ঘিরে যে নিষ্ঠুর উন্মাদনা চলছে তার পেছনে বড় কারণ হলো তিনি জাতিগত দিক থেকে রুশ
ছবি : এএফপি

মেয়েটির বয়স মাত্র ১৫। এটা হচ্ছে সেই বয়স, মানুষ যখন মাত্র স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্নে সে দেখে সুন্দর এক পৃথিবী তার সামনে অপেক্ষমাণ, যে পৃথিবীতে সে সামান্য হলেও নিজের ক্ষুদ্র ছাপ রেখে যেতে হয়তো সক্ষম হবে। তবে ১৫ বছর বয়সের যে বালিকার প্রসঙ্গ এখানে টানা হচ্ছে, সেই বালিকা ছাপ রেখে যেতেই কেবল সক্ষম হয়নি, বরং একই সঙ্গে উন্মোচন করে দিয়েছে বয়স্ক মানুষের অহংকার, ঘৃণা আর প্রতিহিংসার মুখে এমনকি শিশুরাও যে কতটা অসহায় অবস্থায় পড়তে পারে, তারই বিশ্বাসযোগ্য এক ছবি।

হ্যাঁ, আমি কামিলা ভালিয়েভার কথা বলছি। ১৫ বছর বয়সে ফিগার স্কেটিংয়ের আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সে দেখিয়ে দিয়েছিল আত্মপ্রত্যয়ের পাশাপাশি লক্ষ্য অর্জনে অটল থেকে গেলে প্রতিভার মাত্রা কোন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে আবার এটাই সেই বালিকার জন্য শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবে সেই ট্র্যাজেডি অবশ্য একই সঙ্গে খেলার মাঠের বাইরে খেলা নিয়ে যেসব জঘন্য তৎপরতা নিয়মিত আমাদের চোখের সামনে চলছে, আংশিকভাবে হলেও তারই এক বিশ্বাসযোগ্য ছবি তুলে ধরছে।

কামিলার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তা হলো, নিষিদ্ধ ওষুধ সেবন করার মধ্যে দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে নিজের সামর্থ্য সে বাড়িয়ে নেয়। তবে যেভাবে হঠাৎ করে এই অভিযোগ এবং এর ঠিক পরপর পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের ১৫ বয়সী এক বালিকার পেছনে লেগে যাওয়া, তা কিন্তু নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন আবারও আমাদের সামনে নিয়ে আসছে।

পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের এই বালিকাকে ঘিরে দেখানো যে নিষ্ঠুর উন্মাদনা, তা কিন্তু আমাদের প্রথমেই যে বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দেয় তা হলো, কামিলার প্রথম অপরাধ হচ্ছে, সে জাতিগত দিক থেকে রুশ। দ্বিতীয়ত, এমন এক সময়ে বালিকার সেই জাতিসত্তার দিকটি আলোচনায় আসছে, পশ্চিমের চোখে রাশিয়াকে যখন দেখা হচ্ছে ভয়ংকর এক ভিলেন হিসেবে, বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে যে কিনা তৎপর। ফলে সেরকম এক ভিলেনের প্রতিনিধিত্ব করা, এমনকি এক বালিকারও যে সবকিছুই খারাপ, বিশ্বের সামনে সেটা তুলে ধরাকে এরা অনেকটা যেন ধর্মীয় দায়িত্ব পালন হিসেবে মনে করে নিয়েছে।

কামিলার প্রথম অপরাধ হচ্ছে, সে জাতিগত দিক থেকে রুশ। দ্বিতীয়ত, এমন এক সময়ে বালিকার সেই জাতিসত্তার দিকটি আলোচনায় আসছে, পশ্চিমের চোখে রাশিয়াকে যখন দেখা হচ্ছে ভয়ংকর এক ভিলেন হিসেবে, বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে যে কিনা তৎপর। ফলে সেরকম এক ভিলেনের প্রতিনিধিত্ব করা, এমনকি এক বালিকারও যে সবকিছুই খারাপ, বিশ্বের সামনে সেটা তুলে ধরাকে এরা অনেকটা যেন ধর্মীয় দায়িত্ব পালন হিসেবে মনে করে নিয়েছে।

কামিলার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের যে অভিযোগ, সেটা উত্থাপন করেছে সংক্ষেপে ওয়াদা নামের পরিচিত খেলাধুলার জগতে মাদকের ব্যবহারের ওপর নজর রাখার আন্তর্জাতিক সংগঠন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের পর থেকেই ওয়াদা রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ দাখিল করায় নিয়মিতভাবে কাজে করে চলেছে যে দেশটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাদক সেবনের মধ্যে দিয়ে ক্রীড়াবিদদের পারদর্শিতা উন্নত করে নেওয়ার অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত।

ওয়াদার সামনে তখন সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়ার একজন দলত্যাগী কর্মকর্তা, দেশের খেলাধুলার অঙ্গনে মাদকের ব্যবহারের ওপর নজর রাখার সংগঠনে একসময় যিনি কাজ করেছেন। মূলত তাঁর প্রদত্ত স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে ওয়াদার উত্থাপিত অভিযোগের আলোকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অলিম্পিকে রাশিয়ার অংশগ্রহণের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। রাশিয়া অবশ্য পরে ক্রীড়াসংক্রান্ত সালিস আদালতের শরণাপন্না হলে আদালত ওয়াদার দাখিল করা মাদক সেবনে জড়িত রুশ ক্রীড়াবিদদের তালিকা খতিয়ে দেখেন এবং এদের অনেকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অলিম্পিকে রাশিয়ার অংশগ্রহণের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ সংক্ষিপ্ত করে দেন। একই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সেই মেয়াদে রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং দেশের অলিম্পিক কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে রাশিয়ার অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার অনুমতি আদালত তখন দিয়েছিলেন। এখানে অবশ্য আলোচনার মূল বিষয় সেটা নয়। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওয়াদার যে চলমান জিহাদ, তাঁর পটভূমি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্যই কেবল সংক্ষিপ্ত এই আলোকপাত।

কামিলা ভালিয়েভার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ যে ওষুধ সেবনের অভিযোগ আনা হচ্ছে, এবার ফিরে দেখা যাক কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, সেই দিকটিতে। তবে তার আগে পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখা দরকার যে বেইজিং অলিম্পিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে মাদকের উপস্থিতির পরীক্ষা চালানোর জন্য যে নমুনা কামিলার কাছ থেকে নেওয়া হয়, সেখানে কিন্তু নেতিবাচক কিছু পাওয়া যায়নি। নেতিবাচক কিছু পাওয়া যায়নি, এমনকি জানুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ফিগার স্কেটিংয়ে অংশগ্রহণের সময় নেওয়া নমুনা পরীক্ষাতেও। কামিলা সেখানে চমক লাগানো বিশ্ব রেকর্ড গড়ে নিয়ে মহিলাদের ফিগার স্কেটিংয়ের এককে শিরোপা জিতেছিল।

যে নমুনার দৃষ্টান্ত ওয়াদা প্রমাণ হিসেবে হাজির করেছে, সেটা সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর, রাশিয়ার জাতীয় ফিগার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ চলার সময়। সেই ফলাফলকে ওয়াদা নাটকীয়ভাবে উপস্থিত করেছে বেইজিং অলিম্পিকে দলগত ফিগার স্কেটিংয়ের ফাইনাল শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক পর মুহূর্তে। কামিলা সেখানেও অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়ে দলের স্বর্ণপদক জেতায় বিশাল অবদান রাখে।

ফলাফল ঘোষণার পর সাধারণত পদক প্রদানের যে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ ঘোষণা আসে, বিশেষ কারণে অনুষ্ঠান বাতিল করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির পক্ষে থেকে পরে জানানো হয় যে স্বর্ণপদক বিজয়ী রুশ দলের একজন সদস্যের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় বিজয়ী দলকে স্বর্ণপদক দেওয়া হবে কি না সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগপর্যন্ত পদক বিতরণ স্থগিত থাকবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এর ঠিক পরপর জানায় যে অভিযুক্ত ক্রীড়াবিদ হচ্ছে ১৫ বছর বয়সী কামিলা ভালিয়েভা।

ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম ছুরি হাতে নিয়ে ধেয়ে আসতে শুরু করে বালিকার পেছনে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি একই সঙ্গে আরও ঘোষণা করছিল যে মহিলাদের এককে কামিলার অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হবে। রাশিয়ার ফিগার স্কেটিং সংগঠন এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে খেলাধুলার সালিস আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত কামিলার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে প্রতিযোগিতায় তার অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সালিস আদালতের রায়ে যে দুটি দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় তা হলো, বিশ্বের কোনো দেশেই অপ্রাপ্তবয়স্ক কারও বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ঢালাওভাবে মেনে নেওয়া হয় না। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে অলিম্পিক কমিটির নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সিদ্ধান্ত, সেটার সময়সূচি নিয়ে দেখা দেওয়া বিভ্রান্তি। নমুনা ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সংগ্রহ করা হলেও এতটা দেরিতে ফলাফল আসা এবং সেই ফলাফল দলগত ইভেন্টের ঠিক পরপর হাজির করা সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। ওয়াদা কেন ফলাফল আগে প্রকাশ না করে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষায় ছিল, তার সন্তোষজনক উত্তর কোনো পক্ষে থেকেই পাওয়া যায়নি। সালিস আদালতের রায় অবশ্য মহিলা এককে অংশ নেওয়ার সুযোগ কামিলার জন্য করে দিয়েছিল। তবে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখে অল্প বয়সী এক বালিকা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্য রায় ঘোষণার সময় থেকেই দেখা দিয়েছিল।

আসুন, এবার এই ট্র্যাজিক নাটকের শেষ দৃশ্যে আমরা যাই। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছিল মহিলা এককের শেষ অংশ, ফ্রি স্কেটিং হিসেবে যেটা পরিচিত, সেই প্রতিযোগিতা। এক সপ্তাহ ধরে ওয়াদা, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও সেই সঙ্গে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের ক্রমাগত হামলার মুখে পরেও কামিলা যে মনোবল হারিয়ে ফেলেনি, সেই প্রমাণ সে রেখেছিল দুদিন আগে শেষ হওয়া প্রতিযোগিতার প্রথম অংশ শর্ট প্রোগ্রামে। শুরুতে কিছুটা বিচলিত ওকে দেখা গেলেও মুহূর্তে সেই দ্বিধা সে কাটিয়ে উঠে এবং নাচ ও বরফ জমা রিঙ্কের ওপর কাব্যিক গতিবিধির জাদুকরী ছাপ রেখে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে চমক সে আবারও সেখানে দেখায়। ফলে শর্ট প্রোগ্রামে সবার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে শীর্ষে ছিল ওর অবস্থান।

তবে এর ঠিক পরপর সালিস আদালতের দেওয়া রায় সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বলে বসে যে কামিলা পদক জিতলেও পদক তাকে দেওয়া হবে না এবং পদক অনুষ্ঠান অলিম্পিক কমিটির পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হবে। সেই সঙ্গে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে একই পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম নতুন করে আবারও লেগে যায় ১৫ বছর বয়সী সেই বালিকার পেছনে। এতটা কম বয়সে এর আগপর্যন্ত কামিলা সবকিছু সামাল দিতে পারলেও শেষ এই আঘাত আসলেই ছিল অনেকটা যেন মারণ আঘাত। তাই ফ্রি প্রোগ্রামে আগের সেই কামিলার ছাপ ছিল একেবারেই অনুপস্থিত এবং এর আগপর্যন্ত সব কটি প্রতিযোগিতায় দৃঢ়তার সঙ্গে পারদর্শিতা দেখানো কামিলাকে সেখানে তিনবার হোঁচট খেতে হয়। এরপর আমরা কামিলাকে দেখি চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার অপেক্ষায় কোচের পাশে বসে থাকতে। অশ্রু ঝরছিল বালিকার চোখে আর মুখে। ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর সেই কান্না রূপ নেয় বাঁধ ভাঙা চোখের জলে আর সেই সঙ্গে কোচের কোলে মাথা রেখে ওকে বলতে শোনা যায়, ‘তবে পদক অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যাচ্ছে না।’

এ যেন গ্রিক ট্র্যাজেডিরই এক সংলাপ, আমাদেরও যা কিনা অশ্রুসিক্ত করে দেয়। আর সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় সেরকম বাস্তবতা যে সংকীর্ণ স্বার্থের মুখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক বালিকার বুকে ছুরি চালাতে কোনো অবস্থাতেই পিছপা হয় না সেই সব বয়স্ক পাপীরা, নৈতিকতার দোহাই দিয়ে পেছনের দরজার নোংরা খেলায় যারা নিয়মিত জড়িত। কামিলার কান্না তাই হয়ে উঠুক আমাদের সবার জন্য সেই প্রেরণা আর প্রার্থনার উৎস, যা কিনা আমাদের স্বপ্ন দেখাবে খেলার জগতে সুষ্ঠু মন-মানসিকতার আবারও ফিরে আসার এক স্বর্ণালি সময়ের।

মনজুরুল হক জাপানপ্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক