নির্বাচন

কামাল হোসেন বিতর্ক

ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি
ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি

ড. কামাল হোসেনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য নিয়ে সমাজে নানা আলোচনা চলছে। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর প্রচেষ্টাও ছিল লক্ষণীয়। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন ও মানবাধিকারের অনুকূল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে যে কর্মসূচিগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে তাঁর চিন্তাভাবনার ছাপ রয়েছে।

অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন সমালোচিত হচ্ছেন কিছু কারণে। সম্প্রতি তিনি নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে আলোচনাকালে পুলিশকে ‘জানোয়ার লাঠিয়াল বাহিনী’ বলেছেন বলে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন তাঁর প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছে। তাঁর শব্দচয়নে ভুল ছিল, কিন্তু তাঁর ক্ষোভ প্রকাশে ভুল ছিল কি না, এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন আমরা বিবেচনা করতে পারি।

পুলিশের প্রতি ড. কামাল হোসেনের ক্ষোভ আগামী নির্বাচন ঘিরে তাদের নানা কর্মকাণ্ড ও বিচ্যুতি নিয়ে। যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার কাজে পুলিশের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু এবারের নির্বাচনে পুলিশের একপেশে ভূমিকার নানা খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু ঘটনায় পুলিশ নিজে ঐক্যফ্রন্টের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী সমাবেশ ও মিছিলের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। বহু ঘটনায় ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি এবং বাম জোটের প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর সরকারি দলের হামলার সময় পুলিশ নির্বিকার থেকেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মামলা দিতে গেলে পুলিশ বরং ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে বিরোধী দলের ওপর নির্বিচার হামলাকে উৎসাহিত করার মতো।

পুলিশ জনগণের করের টাকায় বেতনভোগী রাষ্ট্রের একটি বাহিনী। সরকারের মন্ত্রীরা তাঁদের বেতন আর সুবিধাদির জোগান দেন না। দেয় দেশের জনগণ। জনগণের করের টাকায় প্রতিপালিত হয়ে তাদের একটি অংশের ওপর চড়াও হওয়া বা তাদের রক্ষার আইনগত দায়িত্ব পালন না করা কতটা মানবিক, তা আমরা পুলিশকেই বিবেচনা করার অনুরোধ করছি। পুলিশের বিরুদ্ধে আরও বড় অভিযোগ: কোনো নাশকতার ঘটনা ছাড়াই ঢালাওভাবে গায়েবি মামলা করা, বিরোধী দলের যে কাউকে গ্রেপ্তারের জন্য অজ্ঞাতনামা বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা। মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানকালীন ব্যক্তি, এমনকি তরিকুল ইসলামের মতো আইসিইউতে মরণাপন্ন নেতাও পুলিশের এসব মামলার শিকার হয়েছেন। পত্রিকার পাতায় আমরা অসহায় মা, স্ত্রী আর শিশুর আর্তির যে হৃদয়বিদারক ছবি দেখছি, তা এসব মামলার কারণেই সৃষ্ট। পুলিশের কাছেই জিজ্ঞাসা, হাজারো অসহায় পরিবারের জন্য এমন নিদারুণ যাতনা সৃষ্টি করা আইনানুগ কি না, মানবিকতার পরিচায়ক কি না?

ড. কামাল সারা জীবন আইনের শাসনে বিশ্বাসী একজন মানুষ। এরশাদ ও বিএনপির শাসনামলে তিনি বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, বহু বেআইনি পদক্ষেপ আদালতে গিয়ে রুখে দিয়েছেন। তিনি ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব গ্রহণ করায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছেন, এমন কোনো কোনো ব্যক্তির পক্ষেও তিনি বিনা পয়সায় আইনি লড়াই লড়েছেন বিএনপির আমলে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার পর তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সারা জীবন রাষ্ট্রের বাহিনীগুলোকে যখন তিনি রাষ্ট্রের মালিক জনগণের ওপর চড়াও হতে দেখেছেন, সোচ্চার হয়েছেন। এখন পুলিশকে এই ভূমিকায় দেখে তাঁর সোচ্চার হওয়াই স্বাভাবিক।

এমন একজন নিবেদিত ব্যক্তির অসংগত শব্দচয়নের জন্য পুলিশ তাঁর ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছে। পুলিশ তা করতেই পারে। কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমাদের মনে অনেক প্রশ্নই আসে—শান্তিপূর্ণ সমাবেশে চড়াও হওয়া, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের পক্ষের লোকজনের পাশবিক হামলার
সময় পর্যন্ত নিশ্চল থাকা, বিনা বিচারে মানুষ খুন আর গুমে অংশ নেওয়া বা এসব রোধে ব্যর্থ হওয়া, মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়াসহ নানান অন্যায় আর বিচ্যুতির জন্য পুলিশ কি নিজে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে মানুষের কাছে? কখনো কি তাদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছে হেয় করার জন্য যারা দায়ী, তাদের কাছে কোনো প্রতিবাদ করেছে পুলিশ?

আমি তো মনে করি, পুলিশের এসব আচরণের জন্যই বরং তারা মানুষের কাছে হেয় হয়েছে। সেটি এই আমলে যেমন, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির আমলেও তেমনি।

২.
ড. কামাল হোসেনের প্রতি অনেকের রাগ, কেন তাঁর জোটসঙ্গী বিএনপি ধানের শীষে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ২২ জন প্রার্থীকে। কিন্তু এই রাগ পুরোপুরি সংগত নয় নানা কারণে। ধানের শীষে জামায়াতে ইসলামীর যে ২২ জন মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের কেউ যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত হননি। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকে ১৯৭১ সালেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন বলে আমরা তাঁদের স্বাধীনতাবিরোধী বলতে পারি। স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্বাচনে অংশ নিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার আইন করতে পারত আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতাকালের ১০ বছরে। তারা যেহেতু তা করা বা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করাও সংগত মনে করেনি, তাই এই ২২ জনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দায় তাদের ওপরও বর্তাবে। আমরা কি ২২ জন জামায়াতে ইসলামী নেতার মনোনয়নের সুযোগ নিয়ে সমালোচনা করার সময় এটি মনে রাখি? আমরা কি এটা লক্ষ করি যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটেও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন? রয়েছেন এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন ব্যক্তিও? কাজেই আওয়ামী লীগকে দোষারোপ না করে শুধু ড. কামাল বা বিএনপিকে এ জন্য দোষারোপ করলে তা কীভাবে যৌক্তিক হয়?

ড. কামাল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের মনোনয়ন দেবে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব গ্রহণ করতেন না। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে জিতলে তাঁদের কেউ সরকারে থাকলে তিনি এক দিনের জন্যও আর ফ্রন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন না। অন্তত একই ধরনের বক্তব্য কি আমরা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে আশা করতে পারি?

ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব থাকার জন্য এখন, এমনকি স্বাধীনতাসংগ্রামকালে কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়েও নির্লজ্জ মিথ্যাচার চলছে। যে মানুষটি পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, আলোচনা, সংগ্রাম, নির্বাচন—সবকিছুতে বঙ্গবন্ধুর নিকটতম ও বিশ্বস্ত একজন হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, যাঁকে বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান হওয়ার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁর সে সময়কার ভূমিকাকে কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবিদারেরা? এটা বঙ্গবন্ধুর বিবেচনাবোধ ও নেতৃত্বগুণের অবমাননা ছাড়া আর কী হতে পারে?

৩.
কামাল হোসেন সংসদীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনে আজন্ম বিশ্বাসী একজন মানুষ। মানুষের ভোটাধিকার না থাকলে এসবের কিছুই থাকে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে এ দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। তখনকার ভোটাররাসহ নতুন ভোটাররা মিলে কয়েক কোটি মানুষ এবার প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। সেটি নিশ্চিত করার জন্য তিনি তাঁর অতি ব্যস্ত পেশাজীবন থেকে দূরে থেকে, বহু সমালোচনা আর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তাঁর দু–একটি শব্দচয়নে ভুল আর কিছু ব্যর্থতার জন্য এত বড় অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কোনো যুক্তি নেই স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিরন্তর ও নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টাকে এতটুকুও প্রশ্নবিদ্ধ করার।

তাঁর মতো কিছু মানুষের প্রচেষ্টার জন্য আগামী নির্বাচনে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করার এবং পছন্দমতো প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন হয়তো। এই অধিকার যেন মানুষ সত্যি প্রয়োগ করতে পারেন এবং মানুষের ভোটের হিসাবেই যাতে আগামী সরকার গঠিত হয়, সেদিকেই বরং আমাদের সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক