আর মাত্র ছটা দিন বেঁচে থাকলেই আমরা তাঁকে সাতাশিতম জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাতে পারতাম। ধানমন্ডির ভাড়া করা বাসায় পৌঁছে যেতে পারতাম ফুল নিয়ে। বলতে পারতাম, ‘শুভ জন্মদিন, কামাল লোহানী। বাংলাদেশ আপনাকে নিয়ে গর্বিত।’
বলা হলো না। ২০ জুন তিনি চলে গেলেন। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্ম নেওয়া গণসংস্কৃতির এই সংগ্রামী পুরুষ আর ফিরবেন না।
মৃত্যুদিনের পর তাঁর মেয়ে উর্মি লোহানীকে আর ফোন করিনি। ধাতস্থ হতে সময় দিয়েছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, এ রকম সময় সহমর্মিতা কিংবা শোকের প্রকাশ কোনো কাজে আসে না। স্থির হয়ে শুধু তা গ্রহণ করা হয়।
কয়েক দিন কেটে গেলে মৃত্যুঘোর কাটতে থাকে। ধীরে ধীরে জীবন তার নিজের জায়গায় ফিরতে থাকে।
কাল সন্ধ্যায় তাই ফোন করা হয়। তার সঙ্গে সংবাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পরদিন বাবাকে ছাড়া বাবার প্রথম জন্মদিন পালন করবেন পরিবারের সন্তানেরা।
গতকাল একটি অনলাইন লাইভে দেখেছি, সাগর লোহানী কথা বলছেন। সাংবাদিকতা, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি নিয়ে যখন কথা বলছিলেন তিনি, তখন বলছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লোহানীর সম্পৃক্ততার কথা। বঙ্গবন্ধু জানতেন, কামাল লোহানী তাঁর দলের রাজনীতি করেন না। তারপরও তাঁর সততার জন্য, তাঁর দায়বদ্ধতার জন্য ভালো বেসেছেন লোহানীকে।
আমি কথা বললাম ছোট মেয়ে উর্মি লোহানীর সঙ্গে। তাঁরা এখন চৌদ্দ দিনের আইসোলেশনে আছেন। ১৮ জুন যখন হাসপাতালে নেওয়া হলো, তখন অনেকক্ষণ ধরে বাবার হাত টিপে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে নিজের ও বাবার হাত ভালো করে মুছে দিয়েছিলেন। তখনো জানতেন না, করোনার বীজ তাঁর বাবার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
এখন স্থিত হওয়ার সময়।
মৃত্যুর পরদিন কামাল লোহানীকে নিয়ে আমার একটি লেখা প্রথম আলোয় ছাপা হওয়ার পর নাট্যজন তবিবুল ইসলাম বাবু ফোন করে জানিয়েছিলেন একটি ঘটনা। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে সত্তরের দশকে একটি নাটক লিখেছিলেন ও পরিচালনা করেছিলেন থিয়েটারের আবদুল্লাহ আল মামুন। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে (তবিবুল ইসলাম বাবু বলেছিলেন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স) একই প্রতিষ্ঠান কি না, আমার জানা নেই।)
নাটকের একটি দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন কামাল লোহানী আর তবিবুল ইসলাম। সে নাটকের স্ক্রিপ্টে দাবি ছিল, চরিত্রটি প্যান্ট–শার্ট পরবে। এখন কী করা! কামাল লোহানীর কোনো প্যান্ট–শার্ট নেই। পাজামা–পাঞ্জাবিতেই তিনি অভ্যস্ত। সমস্যাটার কথা তিনি জানান তবিবুল ইসলামকে। তাঁদের দুজনের গড়ন ও উচ্চতা এক রকম ছিল। ফলে তবিবুল ইসলাম তাঁর বাড়ি থেকে নিজের শার্ট আর প্যান্ট দিলেন পরতে। উতরে গেল অভিনয়।
উর্মী লোহানী আমাকে লিখেছিলেন, জীবনে ওই এক দিনই বাপিকে জামা–প্যান্টে দেখেছি।
লেখাটি নিয়ে প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় নানা কথা বলতে বলতে একটি অনন্য ভাবনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তিনি জলের মতো স্বচ্ছ ছিলেন। নইলে নিজের ছেলেমেয়েদের নাম জলের সঙ্গে মিলিয়ে রাখলেন কী করে? কেউ কি সে প্রশ্ন করেছিল?’
সত্যিই তো, কামাল লোহানীর তিন ছেলেমেয়ের নাম সাগর, বন্যা আর উর্মি। পানির প্রবহমানতার মতো জীবনের প্রবহমানতাকে প্রমাণ করার জন্যই কি ছেলেমেয়েদের এই নামকরণ?
সেটা আর কামাল লোহানীর কাছ থেকে জানা যাবে না।
উর্মি বললেন, ‘ইতিহাস বিষয়ে বাপির ছিল টনটনে জ্ঞান। যা বলতেন, সন–তারিখ ঠিকঠাক উচ্চারণ করতেন। খুব অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আগে স্মৃতি তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেনি কখনো।’
অনেকই প্রশ্ন করেন, রাজনীতি আর সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত একজন মানুষ হঠাৎ নাচের সঙ্গে যুক্ত হলেন কী করে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একদিন আমি গিয়েছিলাম কামাল লোহানীর কাছে। বোধ হয় সেটা ২০১২ বা ১৩ সালে। অনেকক্ষণ ধরে অনেক ধরনের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। আজ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য নাচের সঙ্গে তাঁর যুক্ত হওয়ার বিষয়টি বলছি।
তিনি বলছিলেন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জাকে সরিয়ে বসল ক্ষমতায়। আইয়ুব খান আসার পর আমরা পরিকল্পনা করছিলাম বুলবুল একাডেমিতে। বলছিলাম, সারা বিশ্বেই ডান্স ড্রামা হয়। বাংলাদেশে এত লোককাহিনি আছে, কিন্তু নৃত্যনাট্য হয়ই না বলতে গেলে। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ হয়েছিল। কিন্তু তার হদিস কেউ জানে না।’
আমাদের সঙ্গে সে সময় ছিলেন কামরুল হাসান, অজিত গুহ, আনিসুজ্জামান। বাফার নামেই হয়েছে। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ করার স্বত্ব অবশ্য দেওয়া হলো জি এ মান্নানকে। বাফাকে নয়। কমলাপুরে কবি জসিমউদ্দীনের বাড়িতে জি এ মান্নানের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। কবি লিখে দিলেন, নৃত্যনাট্যটি বাণিজ্যিক কারণে যেন মঞ্চস্থ না হয়।
এখানে বলা দরকার, আইয়ুব খানের মার্শাল ল হওয়ার পর সরকার ছিল বাংলা সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ। তারা চাইছিল, বাঙালি সংস্কৃতি যেন বিকশিত না হয়। মুসলিম লীগের চিন্তাভাবনাই ধারণ করেছিল সামরিক শাসন। বুলবুল একাডেমিতে তাই দেওয়া হয়েছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। যাঁকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি নিজেও নাচতেন আগে। ফলে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে বললে তিনি তো তা করলেন না। এতে শাপে বর হলো। আমরা যা চাইতাম, সেটাই তিনি করলেন। আমাদের এই কাজটায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন কামরুল ভাই, ময়না ভাই (এ কে এম মুস্তবা) আর জি এ মান্নান। কামরুল ভাইয়ের কলকাতা ইউনিভার্সিটির বন্ধু ছিলেন ময়না ভাই। ছিলেন বুলবুল একাডেমির শিক্ষক। সঙ্গে অজিত গুহ ছিলেন, তোফাজ্জল হোসেন, আনিসুজ্জামানকেও পেয়েছিলাম।
কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেছিল।
নাচের মহড়া করাতে গিয়ে জি এ মান্নান দেখলেন, মেয়েরা তো আছে। কিন্তু ছেল নেই। মন্দিরা, রাহিজা, কচিসহ অনেকেই আছে। ছেলে পাওয়া যাবে কোথায়। দুজন মাত্র ছেল ছিল। অজিত দে আর জ্যাকব পিউরিফিকেশন। আরও অন্তত তিন–চারজন লাগবে। জি এ মান্নান আমাকে বললেন, তুমি নাচ জানো? আমি বললাম, না। ১৯৫৬ সালে জি এ মান্নানের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তাই তিনি ভেবেছিলেন, আমি নাচ জানি। আমি আসলে আট বছর বয়সে বুলবুল চৌধুরীকে দেখেছিলাম। যেমন চেহারা, তেমনই দেহসৌষ্ঠব। তখন ভাবতাম, ইশ! যদি নৃত্যশিল্পী হতে পারতাম!
জি এ মান্নান বললেন, ‘তুমি আমার সাথে দাঁড়াও। আমার দিকে তাকাবে।’
দাঁড়ালাম। তাকালাম।
‘পাজামা একটু গোটাও।’
গোটালাম।
বললেন, ‘তোমাকে দিয়ে নাচ হবে।’
বললাম, ‘আমি তো নাচ জানি না।’
বললেন, ‘জানার ব্যাপারটা আমার দায়িত্ব।’
তিনি আসলে পা দেখতে চেয়েছিলেন হাঁটু দুটো লেগে যায় কি না, সেটা দেখতে। আমার হাঁটু লাগত না, তাই বললেন, ‘ঠিক আছে।’
শুরু হলো কামাল লোহানীর নাচ শেখা।
এরপর নাচের দলের সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ঘুরে এসেছিলেন। এবং সেই মধ্যপ্রাচ্য সফরেই দারুণ রকম এক কথা–কাটাকাটির শিকার হয়েছিলেন দলনেতার সঙ্গে। সে আরেক গল্প।
আজ এ গল্পটি দিয়েই কামাল লোহানীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।