কাবুলের হতাশ বাসিন্দারা সবাই সবাইকে দুষছেন

কাবুলের বাসিন্দাদের অনেকে দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরের দিকে ছুটছে।
ছবি: রয়টার্স

তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি চুক্তি চারটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হচ্ছে-যুদ্ধবিরতি, বিদেশি বাহিনী প্রত্যাহার, আন্তঃআফগান আলোচনা ও সন্ত্রাস দমন নিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান এগুলো বিবেচনা করে গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। এমনকি চুক্তির বিষয়গুলো আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ এবং আলোচনা করে তৈরি করা হয়নি। এটাও আশ্চর্যজনক যে, একটি স্বাধীন দেশের পরিচালনার বিষয়ে সেই দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে পাশ কাটিয়ে একটি বিদেশি শক্তি ও একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তিটি এত সহজ এবং সংক্ষিপ্তভাবে সংজ্ঞায়িত যে, যে কেউ এটির অপব্যবহার করতে পারে বা নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

এটাও একটা বিস্ময় যে, কেন আমেরিকানরা এখন আফগানিস্তানে সাড়ে পাঁচ হাজার সৈন্য পাঠাচ্ছে, যেখানে প্রত্যাহারের আগে তাদের প্রায় ২,২০০ সৈন্য ছিল। অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও এই তিন দিনের মধ্যে প্রায় ১,০০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। আমরা অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে তথ্য পাচ্ছিলাম, তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ না করার জন্য মাঠ পর্যায়ে থাকা বাহিনীকে নির্দেশ দিচ্ছিল হাইকমান্ড।

আফগানিস্তানকে গত বিশ বছরে আমেরিকা ৩ লাখ আফগান সৈন্যের প্রশিক্ষণ, বেতন, ভাতা, অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য তাদের তৈরি করেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তা একটি পুরোপুরি ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছিল। এর মধ্যে গোটা বিষয় নিয়ে নানা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বও’ শোনা যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলীয় আফগান প্রদেশ বালখের প্রাক্তন গভর্নর আতা মোহাম্মদ নূর (যিনি রাজধানী মাজার-ই-শরিফ তালেবানদের হাতে পড়ার সময় স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন) ফেসবুক পেজে লিখেছেন যে, ‘দুর্ভাগ্যবশত, একটি বৃহৎ, সংগঠিত এবং কাপুরুষোচিত ষড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ এটি, সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সরকারি বাহিনী তালেবানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’

তালেবানের কাবুল দখলের মধ্যে গত রোববার আশরাফ গনি দেশ ছেড়েছেন। আফগান সরকারের কোনো নেতৃত্ব ছাড়াই দেশটি এখন বিপর্যস্ত। তালেবান দেশটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। কাবুলের সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে হতাশা, যন্ত্রণা ও দেশ পরিত্যাগের অনুভূতি ভর করেছে। এখন এখানে সবাই সবাইকে দোষারোপ করছে। আমার অফিসে সকল নারী কর্মীরা রোববার তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাহাকার এবং গুরুতর হতাশার মধ্যে অফিস ত্যাগ করেন। তাদের অনেকেই শিশুর মতো কাঁদছিল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব কিনা? আমি তাদের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। তারা জিজ্ঞাসা করছিল যে, তারা মেয়েদের শিক্ষা, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার এবং দেশের অন্যান্য বিষয়ে যে উন্নয়ন অর্জন করেছে তার কি হবে? কেউ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না, এখন যা হচ্ছে তা কি সত্যি?

এখন এখানে সবাই সবাইকে দোষারোপ করছে। আমার অফিসে সকল নারী কর্মীরা রোববার তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাহাকার এবং গুরুতর হতাশার মধ্যে অফিস ত্যাগ করেন। তাদের অনেকেই শিশুর মতো কাঁদছিল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সম্ভব কিনা? আমি তাদের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।

প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত চার মাসে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছিলেন। তিনি তার সরকারকে সমর্থন ও সুরক্ষার জন্য আমেরিকানদের সঙ্গে তদবিরও করছিলেন। শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। এখন, সারা দেশে খাদ্য সামগ্রী, সরবরাহ, তেল এবং অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মারাত্মক সংকট রয়েছে। এগুলোর দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। লোকেরা দোকানে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ ছাড়াই ফিরে আসছে। প্রায় সব দোকান বন্ধ। এমনকি যদি একটি দোকান খোলা হয়, লোকেরা তাৎক্ষণিকভাবে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এক মিনিটের মধ্যে সবকিছু দখল করতে আগ্রহী। সারা দেশে কয়েক লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছে। আশ্রয়হীনদের অধিকাংশই নারী, মেয়ে ও শিশু।

হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান ও ইরানের সব সীমান্ত বন্ধ। এই মানুষগুলো রাস্তাঘাটে খাবার ও সঠিক আশ্রয় ছাড়া বসবাস করছে। দেশ থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য ফ্লাইট পেতে হাজার হাজার মানুষ কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দখল করেছে। এমনকি বিমানবন্দরের ভেতরে লোকজনকে আটকাতে পুলিশকে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছিল। কিন্তু তাদের থামানো অসম্ভব ছিল। এ কারণে এয়ারলাইনসগুলোও কাবুলে কাজ করতে দ্বিধাবোধ করছে। টিকিটের দাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি। গত তিন দিন ধরে আমি ব্যক্তিগতভাবে টিকিটের জন্য চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটি পাওয়া যায়নি।

গত তিন চার দিনে হাজার হাজার মানুষ তাদের ব্যালেন্স থেকে টাকা তুলতে ব্যাংকে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে, তাদের কাছে টাকা নেই। সর্বত্র সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা এবং হতাশা বিরাজ করছে। কোনো কিছুর দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। অনেকে গনি সরকারকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিহিত করছেন। ফলে অনেকে বলছেন যে, এখন তালেবানের কারণে দুর্নীতির মাত্রা কম হবে। তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, মেয়েদের শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে শঙ্কাও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তালেবানরা এখন একজন প্রেসিডেন্ট এবং একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে নিয়োগ দেবে। আগামী সপ্তাহ থেকে আংশিকভাবে সমস্ত অফিসও খোলা হবে। তারা নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে সব মন্ত্রীকে ধীরে ধীরে নিয়োগ দেবে। এই সরকার আগামী ছয় মাস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা এক বছর পর্যন্ত কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সময়ে তারা চিহ্নিত করবে কীভাবে তারা দেশ পরিচালনা করতে চায়। এটা আশা করা হয় যে, তারা আমেরিকান মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। অন্যথায়, স্বীকৃতি পেতে সহজতর হবে না। তাদের পুরো কাজের জন্য অর্থায়নও দেবে না, যাদের মোট বাজেট পশ্চিমা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। দেখা যাক, আফগানিস্তান এখন কোনো পথে এগোয়।

মৃদুল কান্তি বিশ্বাস আফগানিস্তানে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।