কানত তালা লাগাই দিইয়ি
সিটি করপোরেশন
হন হথা উইনতু নঅ চায়
কী হঅর জনগণ
ইয়ান এক্কান হথা অইল না
ফুটপাতথ দোয়ান
রাস্তার উদ্দি গাথত পড়ি
হাড্ডি ভাঙি ছোয়ান
দিন দুইরগ্যা মশা অক্কল
খাই যাইরগুদে রক্ত
এন হারবার কেনে গরের
তারা একখানা হঅকত।
(সিটি করপোরেশন কানে তালা দিয়েছে। জনগণ কী বলতে চায়, সেটা তারা শোনে না। এটা কোনো কথা হলো—ফুটপাথে দোকান? রাস্তার গর্তে পড়ে হাড় ভেঙে ছয় টুকরা। তারা করোনা রোগীকে রাখে লাইব্রেরির ভবনে। বেতাল কাণ্ডকারখানা দেখে বুকটা হিম হয়ে যায়। দিনে–দুপুরে মশাগুলো রক্ত খেয়ে যায়। তারাই বলুক, এমন কাণ্ড তারা কীভাবে করে?)
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাণ্ড দেখে এমন ছড়া মনে আসে চট্টলাবাসীর। পত্রপত্রিকায় মতামত, লেখালেখি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকদের প্রতিবাদ—কিছুই কানে ঢোকে না সংস্থাটির। রাস্তাঘাট ঠিক রাখা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, সড়কবাতি জ্বালানো, নগরীকে মশামুক্ত রাখা—এসব মূল কাজের একটিও করছে না এই সংস্থা।
ফুটপাতে এখন যত বিড়ম্বনা। চট্টগ্রাম নগরের ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাতের ৮০ ভাগই সারা বছর দখলে থাকে। মাঝেমধ্যে এ দখল বিস্তৃত হয়ে সড়কের মাঝবরাবর চলে আসে। ফুটপাত দখলের এ ভোগান্তির ভেতর সিটি করপোরেশন সম্প্রতি শেরশাহ এলাকায় দেড় কিলোমিটার ফুটপাতে ২৫৫টি দোকান নির্মাণ করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে বরাদ্দ দিয়েছে। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। মানুষ প্রতিবাদ করেছেন নানাভাবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন তাতে কান দেয়নি।
মশা তাড়ানোর কামান দাগার আওয়াজ কদাচিৎ শোনা গেলেও প্রতিমুহূর্ত নগরবাসী কানের কাছে ভ্যানভ্যান আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নিয়ে প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে তিনি মশা তাড়িয়ে দেবেন। বলা বাহুল্য, সেটা তিনি করতে পারেননি। মশা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করতে না পারলে মশার উপদ্রব ঠেকানো যাবে না। সিটি করপোরেশন এ কাজেও ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের আর কোনো সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা ফুটপাতে দোকান নির্মাণ করে বিক্রির বন্দোবস্ত করেছে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে চট্টগ্রামই প্রথম। স্বনির্ভর হতে আয়ের উৎস বের করা ভালো। কিন্তু জনগণের পায়ে কুড়াল মারার মতো এ কাজ সিটি করপোরেশন কোন বিবেচনায় করল, সেটা কারোর মাথায় আসছে না।
নগরবাসীর আরেক দুঃখের নাম মশা। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগের কামান চলছেই, কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রজনন থামছে না। মশকনিধনে চসিকের ক্রাশ প্রোগ্রামের কথা বছরে কয়েকবার শোনা যায়। বলা হয়, নগরের ৪১ ওয়ার্ডের সব কটিতেই দেড় শতাধিক কর্মী কাজ করছেন মশার তাড়াতে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মশা তাড়ানোর কামান দাগার আওয়াজ কদাচিৎ শোনা গেলেও প্রতিমুহূর্ত নগরবাসী কানের কাছে ভ্যানভ্যান আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নিয়ে প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে তিনি মশা তাড়িয়ে দেবেন। বলা বাহুল্য, সেটা তিনি করতে পারেননি। মশা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করতে না পারলে মশার উপদ্রব ঠেকানো যাবে না। সিটি করপোরেশন এ কাজেও ব্যর্থ হয়েছে। আগের মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দিনের আমলে কিছু কিছু এলাকায় ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য নিয়ে আসার প্রকল্প চালু হয়েছিল। সেটি এখনো বলবৎ। কিন্তু সার্বিকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চসিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এ শহরের মোড়ে মোড়ে বর্জ্যের স্তুপ থাকে। মেডিকেল, শিল্পকারখানা, হোটেল–রেস্তোরাঁ, ই–বর্জ্য সব মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে এসব স্তুপে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে বায়েজিদ বোস্তামী থানার আরেফিননগরে এবং হালিশহর আনন্দবাজার এলাকার ভাগাড়ে জমা করেন। পচনশীল বর্জ্য আর অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করে রাখা হয় না। ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সেসব আবর্জনা জমতে জমতে এখন পাহাড়। শেষ পর্যন্ত বর্জ্যের পাহাড় কত উচ্চতায় যাবে এবং এর বিস্তৃতি কত হবে, তা কল্পনা করলে আতঙ্ক তৈরি হয়।
অবশ্য সম্প্রতি সিটি করপোরেশন জাইকার সহায়তায় মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন একটা প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে হালিশহর আবর্জনার ভাগাড়ের পাশে ইনসেনিরেটর বসানো হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নানা দুঃখের ভেতর এই সুখবর কিছু আশা সঞ্চার করলেও জলাবদ্ধতা, গৃহকর বাড়ানো, বেহাল রাস্তাঘাট এবং উল্লেখিত ফুটপাতের দখল নিয়ে মানুষের অসন্তুষ্টির কথা তাদের কানে নিতেই হবে।
শুকনো মৌসুমে আপাতত জলাবদ্ধতার কষ্ট না থাকলেও বেহাল সড়ক মানুষকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প এবং এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে প্রকল্পের কারণে শহরের আগ্রাবাদ থেকে পতেঙ্গার কাটগড় পর্যন্ত সড়কগুলোর কোনো সংস্কার করা যাচ্ছে না। আগ্রাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকার প্রধান সড়কটিতে রাস্তার দুরবস্থার কারণে যানজট লেগে থাকে সারাক্ষণ। একইভাবে বিমানবন্দর সড়কেও একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার পথে বন্দর কর্তৃপক্ষের দপ্তর এলাকায় কাস্টমস, সিইপিজেড, বিপিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। এখানকার রাস্তাগুলোও সংস্কারবিহীন পড়ে আছে। তার জন্য রাতেও এখানে যানজট থাকে।
বিমানবন্দর সড়কের সঙ্গে লাগানো বারিকবিল্ডিং থেকে মাঝিরঘাট, পোর্ট কানেকটিং সড়ক, বহদ্দারহাট–মুরাদপুর সড়ক, শাহ আমানত সেতু থেকে নেমে ফিরিঙ্গিবাজারের দিকে যাওয়ার সড়ক, মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত উড়াল সড়কের নিচের সড়ক, ষোলশহর, অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ যাওয়ার সড়কের অবস্থা করুণ। কিছু কিছু জায়গায় সিটি করপোরেশন ছোটখাটো মেরামতের কাজ করলেও সড়কগুলোর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কাজ না করলে স্থায়ী সমাধান আসবে না। আর তা করতে হবে এই শুকনো মৌসুমেই। নইলে বৃষ্টির মৌসুম এসে গেলে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে শহরে সড়ক বলে আর কিছুই থাকবে না। সময়ের কাজ সময়ে না করতে পারলে জনগণের ভোগান্তি বাড়তেই থাকবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শহরে নানাবিধ সেবায় নিয়োজিত। প্রতিষ্ঠানটি নগরে ৮০টি সফল এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালায়। শিক্ষা খাতে সারা দেশে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তারা। স্বাস্থ্যসেবায়ও সিটি করপোরেশনের কাজ অনবদ্য। ৪টি মাতৃসদন হাসপাতাল এবং ৪৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। প্রতিবছর জমজমাট বইমেলা, বৃক্ষমেলাসহ নানা আয়োজন করছে।
করপোরেশনের অধীনে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরিও আছে। করোনার শুরুর দিকে এখানে করোনার রোগীদের জন্য একটি আইসোলেশন সেন্টার খুলেছিল। সেটা ২০২১ সালের শেষ দিক পর্যন্ত চলেছে। এতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক পাঠক। লাইব্রেরি ভবনে কোভিড রোগীদের রাখার ব্যবস্থাটি নিশ্চয়ই পাঠকবান্ধব ছিল না। তবে এখন সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কথা হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানাবিধ সেবা এবং উদ্যোগের কারণে সিটি করপোরেশন প্রশংসিত হবে তখনই, যখন তারা মূল কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। আগামী দিনে যেন তারা মূল কাজটির কথা ভুলে না যায়। এটিই চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা।
● ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক