‘হামরা জানি সরকার গাছ লাগায়। কিন্তু সরকার যে গাছ কাটে, তাক তো কবার পাইনে।’ রাজারভিটা থেকে মণ্ডলপাড়া হয়ে (চিলমারী উপজেলা সদর) থানাহাট যাওয়ার রাস্তার ছায়াবহুল গাছগুলো কেটে ফেলা দেখে আক্ষেপ করছিলেন রমনা সরকারবাড়ির ভোলা সরকার (৬০)। তিনি আরও বলেন, ‘তার চাইতে হামাক কইলে হয়, হামরায় ফলের গাছ নাগে দিলাম হয়। গাছ সরকারের, ফল হামার।’
উল্লেখ্য, সম্প্রতি উলিপুর থেকে রানীগঞ্জ-রমনা-জোড়গাছ-পাত্রখাতা হয়ে কাশিমবাজার পর্যন্ত পাউবো বাঁধ সংস্কার হয়েছে। সেখানে জনগণ নিজ উদ্যোগে নানান ধরনের ফলদ-বনজ গাছ লাগাচ্ছেন। জোড়গাছ থেকে নন্দীর মোড় পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড আমবাগান করেছে। কারণ, বন বিভাগ বৃক্ষ রোপণ করলে তো কয় দিন পর কেটে নিয়ে যেত। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড তা করবে না। ফলে গাছগুলো একদিন শতবর্ষী হবে।
দুর্গাপূজায় অশোক, তুলসী ও বেলপাতা যেমন লাগে, তেমনি সরস্বতী ও মনসাপূজায় লাগে পলাশ, অপরাজিতা, পদ্ম ও শাপলা ফুল। লক্ষ্মীপূজা, বিশ্বকর্মা ও শিবপূজায় লাগে তিল, হরীতকী ও ধুতরা। বটগাছকে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে পবিত্র গণ্য করা হয়। চাকমারা যেমন নাগেশ্বরগাছকে বোধিবৃক্ষ মনে করে, একইভাবে মনসাপূজার দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যু ঠেকাতে গারোরা যে ‘হেগড়া’ শাকের ডাঁটা লবণ দিয়ে খাওয়ায়, সেই হেগড়াশাক বাঙালি সমাজে ‘ঘাগড়া’ নামে পরিচিত। গাছের সঙ্গে জীবনের, ধর্মের, সংস্কৃতির সম্পর্ক আছে। জনগণ এজমালি জমিতে এসব প্রয়োজনীয় গাছগাছড়া লাগান। যেমন মন্দিরের জমিতে লাগান বেল, চন্দন, বট, হরীতকী, অশোক। কিন্তু এজমালি জমি বন বিভাগের কাছে কাঠ ব্যবসার হাতিয়ার। তাই শতবর্ষী মহিরুহ আর নেই!
২
বন কী? হাজার বছরে হাজার প্রজাতির বৃক্ষ-গুল্ম-লতা আর প্রাণের সমাহার হলো বন। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও মানুষের জ্ঞানভান্ডার হলো তার অংশ। লাখো প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণ এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা বনকে আপন গতিতে টিকিয়ে রাখে। বনের বেড়ে ওঠার স্তরে স্তরে থাকে বহু প্রজাতির বৃক্ষ ও ঝোপঝাড়। তাদেরই ওপর জন্মায় অসংখ্য লতাপাতা। বহু প্রজাতির জীবজন্তু বন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, বনে ঠাঁই নেয় ও বংশ বাড়ায়। এখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীরা মাটি-পানি-সৌরশক্তি ও জলবায়ুর সঙ্গে লিপ্ত থেকে সবার সংরক্ষণ নিশ্চিত করে।
আর গুটিকয় প্রজাতির বৃক্ষের নিবিড় ব্যবস্থাপনাকে তাই বৃক্ষ খামার বলা যায়। মৌসুম শেষে কৃষক যেমন শস্য ঘরে তোলেন, সম্ভাব্য কম সময়ে কাঠ উৎপাদনের জন্য এই বৃক্ষ খামার। কৃষি খামারের আরেক রূপ। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশদের হাত ধরে এই বনায়ন শুরু হয়। গাছ লাগিয়ে ৫-১০ বছর পর আবার গাছ সাবাড় করা হয়। পরিবেশের জন্য উৎপাত সৃষ্টি করে। এখানে সব গাছ এক বয়সী। গাছ কাটার প্রথম দু-তিন বছর আর চারা লাগানোর দু-তিন বছর মাটি ফাঁকা থাকে। তখন মাটি ক্ষয় হয়। মাটির দৃঢ়তা ও উর্বরতা নষ্ট হয়। পুষ্টিচক্রে ভারসাম্য হারায়। ভূমিতে জনগণের অধিকারও হরণ হয়। প্রাণিকুলের কাছে তা মরুভূমির মতো। খাদ্য না পেয়ে তারা অদৃশ্য হতে থাকে। পানির পরিমাণও কমে, মানও নষ্ট হয় এবং টাকার অঙ্কে যত টাকার গাছ লাগানো হয়, গাছ বিক্রি করে অর্ধেক টাকাও ওঠে না।
বন কার? বন কারও নয়। গাছ যেমন বন নয়, তেমনি পশুপাখিও নয়। মানুষ থেকে পিঁপড়ে পর্যন্ত যারা বনবাসী, তারা সবাই মিলে বন। পুরো জীবনব্যবস্থাই বন। তাই পাহাড়ের গাছ জোয়ার-ভাটায় লাগালে বন হয় না। কৃষকের ঘর-গৃহস্থালিতে যে প্রাণব্যবস্থা, তাতে মেহগনি বা ইউক্যালিপটাস খাপ খায় না। এগুলো তাই আগন্তুক বা বিদেশি প্রজাতি। সংসারের ঝামেলা।
প্রাকৃতিক বনকে ব্রিটিশ আইনে সরকারি বন বলে। আর জ্বালানি কাঠের বাগানের নাম সামাজিক বনায়ন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাবমতে, দেশের বৃক্ষশূন্য বা ক্ষয়িষ্ণু এমন সরকারি বনভূমিতে উডলট বা জ্বালানি কাঠের বন সৃষ্টি করা হয়েছে। এডিবির ২০০২ সালে ৪৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের ১২.৩ মিলিয়নই খরচ করা হয়েছে উডলট বা জ্বালানি কাঠের বন বানাতে। প্রকল্পের অন্যান্য প্রধান খাত ছিল কৃষি বনায়ন, রাস্তা, নদীনালার পাড় ধরে বনায়ন, চারা বিতরণ, নার্সারি উন্নয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ। তাই উল্টো সরকারি উদ্যোগে প্রাকৃতিক বন নিধন করা হয় সৃজিত বন বা সামাজিক বনায়নের ব্যবসার স্বার্থে। কৃত্রিম বনকে তাই বন বিভাগ ‘বাগান’ বলে। সামাজিক বনায়ন মূলত অর্থাগমের গল্প। কাঠ ব্যবসার এই সুযোগ প্রাকৃতিক বনকে আরও উজাড় করে। আগন্তুক প্রজাতিগুলো স্থানীয় পরিবেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে, যা মানুষ-প্রাণ-প্রকৃতির জীবনচক্রে সম্ভাবনা ও শক্তি নষ্ট করে।
৩
বন কার? বন কারও নয়। গাছ যেমন বন নয়, তেমনি পশুপাখিও নয়। মানুষ থেকে পিঁপড়ে পর্যন্ত যারা বনবাসী, তারা সবাই মিলে বন। পুরো জীবনব্যবস্থাই বন। তাই পাহাড়ের গাছ জোয়ার-ভাটায় লাগালে বন হয় না। কৃষকের ঘর-গৃহস্থালিতে যে প্রাণব্যবস্থা, তাতে মেহগনি বা ইউক্যালিপটাস খাপ খায় না। এগুলো তাই আগন্তুক বা বিদেশি প্রজাতি। সংসারের ঝামেলা।
১৮৫২ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইউরোপিয়ানদের জন্য রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে জমি কিনতে চেয়ে চিঠি দেয়। উত্তরে সর্দার সিয়াটল বলেন, ‘গাছ রস টেনে নেয় গোপন পথে—আমরা তা জানি, যেমন জানি রক্ত আমাদের ধমনি বেয়ে চলে। আমরা এই ভূলোকের অংশ, যেমন এই ভূলোক আমাদের অংশ। সুরভিত ফুলেরা আমাদের বোন। ভালুক, হরিণ, রাজকীয় ইগল—এরা সবাই আমাদের ভাই। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ প্রান্তরের রস, ঘোড়ার শরীরের ওম আর মানুষ—সবাই আমরা একই পরিবারের সদস্য।’
সামাজিক বনায়ন অসামাজিক ও গণবিরোধী ঘটনা। বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও মাটির গুণ এমনই, মাটিতে পাঁচ বছর হাল না পড়লে আপনা-আপনিই বন গড়ে ওঠে। মোগল সম্রাট আকবর নদ-নদীর দুই পাশে দুই–ছয় মাইলের মধ্যে হাল নিষিদ্ধ করেছিলেন। বন বিভাগও শুধু এটুকুই করুক—কেউ যেন গাছ না কাটে।
● নাহিদ হাসান রেল, নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি।
nahidknowledge@gmail.com