বিশ্বজুড়ে সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের বড় চ্যালেঞ্জ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন প্রতিষ্ঠানের জনবলকে বলা হচ্ছে ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’। রাষ্ট্রীয় তিনটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি, মিল্ক ভিটা ও ডিপিডিসিতে কাজ করে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, শুধু আকাশচুম্বী ভবন বা অবকাঠামোগত শক্তি দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না, যদি তার জনসম্পদ কাজে না লাগে।
সুশাসনের পথে আমাদের কঠিন বাধা হলো কর্মবিমুখতা। কাজকে আন্তরিকভাবে, নিবিড়ভাবে আমরা কয়জন ভালোবাসি? অচল যন্ত্রপাতি সচল করা সহজ, কিন্তু অচল মানুষকে সচল করা কঠিন। ভারতের বর্তমান মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলে থাকেন একসময় মুম্বাইয়ের হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করেছেন। শ্রমের কত মূল্য! প্রতিষ্ঠানের সফলতা আসে শ্রমের মর্যাদায়। সারা দিনের আউটপুট কত, কয়টি নথি নিষ্পন্ন হলো বা অনিষ্পন্ন থাকল, কয়জন গ্রাহক সেবা পেলেন বা ফিরে গেলেন, কত রাজস্ব আদায় হলো, তার চুলচেরা হিসাব নেওয়াটাই জবাবদিহি। নথি নিষ্পত্তির জন্য আমরা দিনের পর দিন সময় অপচয় করি, যা এক ঘণ্টায় নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
অবহেলা-অদক্ষতার সমান্তরালে আছে অফিসের শৃঙ্খলা অমান্য করা। বায়োমেট্রিক হাজিরা সিস্টেমও মানা হচ্ছে না। ভোরে ঘুম থেকে না জাগার অভ্যাস থেকে অফিসে দেরিতে আসার প্রবণতা। দুপুরে ভূরিভোজ করে অনেকে ডুবে যান তন্দ্রায়। দুপুরের ভূরিভোজন কর্মশক্তিতে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। কারণ, মস্তিষ্কে নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্য পরিবর্তনে শর্করার ভূমিকা বেশি। একই প্রতিষ্ঠানে অলস সময় কাটাচ্ছে একদল, আরেক দল প্রচণ্ড কাজের চাপে চোখের পলক ফেলতে পারছে না। আরেক দল ব্যস্ত ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব নিয়ে। নিঃশব্দে অফিসে তাঁদের আগমন, নীরবেই প্রস্থান। অলসতার যতটা না শারীরিক কারণ, তার চেয়ে বেশি মানসিক কারণ। শারীরিক বার্ধক্যের চেয়ে মনের বার্ধক্যে জীবনের গতি থমকে যায়। অথচ বেতন, ভাতা, বোনাস, ছুটি, পদোন্নতি পেয়েও দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাঁদের বিবেক দংশিত হয় না।
মাঠপর্যায়ে পরিবীক্ষণ ও পরিদর্শন যত জোরালো হয়, তত দুর্বল হয় দুর্নীতি ও অনিয়মের বলয়, কঠোর হয় অনুশাসন। চার দেয়ালের আবদ্ধ কক্ষে বসে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের অধীনস্থ অফিসে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দিবাস্বপ্নের মতো। মাঠে নামলে উপলব্ধি করা যায়, গ্রাহকের যন্ত্রণা, জনগণের বেদনা। গবেষণায় এসেছে, অলস মানুষের রোগাক্রান্ত ও জরাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কর্মঠ মানুষের চেয়ে চার গুণ বেশি। শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে না লাগানো মূলত ‘ইন্টেলেকচুয়াল করাপশন’।
অফিসে সেবাপ্রার্থী মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে মোবাইল ফোনে চলছে একশ্রেণির কর্মকর্তার বিরামহীন কথন। একটু সময় ও সহানুভূতি প্রত্যাশা করে মানুষ। এক গ্রাহকের অভিযোগ, তাঁকে দুই ঘণ্টা বসিয়ে রেখে অফিসের প্রধান টিভি দেখেছেন, সিগারেট ফুঁকেছেন। আবেদনপত্রে সব কাগজ দেওয়ার পরও হারিয়ে গেছে ডকুমেন্ট। ঘাম ঝরিয়ে অফিসে আসা এসব মানুষের অশ্রু কখনো মুছে যায় না। উন্নত দেশগুলোতে করপোরেট সেবা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের ঘরে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজের মানোন্নয়নের জন্য এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুসৃত হচ্ছে SS-CQI-TQM।
দুবাইয়ের শাসক শেখ মাখদুম ‘সিটিজেনস হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ নামে অনলাইনে নাগরিক সেবার ওপর গ্রাহক সন্তুষ্টি সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছেন। সিঙ্গাপুরে অনলাইনে আবেদনের ১৫ মিনিটের মধ্যেই মিলছে ব্যবসার ছাড়পত্র। অথচ আমরা এসব থেকে সহস্র যোজন দূরে। ব্যক্তিগত সম্পদ ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় আমরা কত হিসাবি! কিন্তু পেশাগত জীবনে অনেক বেহিসাবি। তাই অফিস সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে সাশ্রয় এবং যানবাহন ব্যবহারেও রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। এভাবে অপচয়, অবহেলার স্রোতে এবং মানুষের বুকভাঙা কষ্টে প্রতিষ্ঠান ধাবিত হয় ধ্বংসের পথে। করপোরেট উত্থান-পতনের তত্ত্ব অনুসারে ইতিহাসের আপন গতিতে এভাবে তলিয়ে গেছে বহু প্রতিষ্ঠান।
>মহাকালের হিসাবে খুব ক্ষুদ্র আমাদের পার্থিব জীবনের স্থায়িত্ব, যা শুধু উপভোগে ব্যয় না করে আমরা বর্ণাঢ্য কর্মময় করতে পারি। অবহেলায়, অদক্ষতায় একটি প্রতিষ্ঠানকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া সহজ, কিন্তু টেনে তোলা অনেক কঠিন
মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত জীবনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাই ব্যক্তির পারিবারিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে পেশাগত জীবনেও। কৈশোর-যৌবনে অভিভাবকের অবাধ্য হওয়া, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, নীতিহীনতা, ঈর্ষাপরায়ণতা পরবর্তী সময়ে করপোরেট জীবনধারায়ও ক্রিয়াশীল থাকে। সুতরাং করপোরেট-অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শুধু তিরস্কার, পদাবনতি বা বরখাস্তের মতো পদক্ষেপ নেওয়া গাড়ি রিকন্ডিশনিং বা ওভারহোলিং করার সমতুল্য, এতে প্রতিষ্ঠানে সচলতা, শুদ্ধতা আসে না। ব্যক্তির কর্মমূল্যায়নের মানদণ্ড হবে নিখুঁত সততা, অসাধারণ দক্ষতা এবং অনবদ্য অবদান ও উদ্ভাবন। এটিই সুশাসনের মূলমন্ত্র। ‘সবল’কে বাঁচিয়ে ‘দুর্বলে’র ওপর অপরাধের বোঝা চাপানো, তোষামোদি-চাটুকারিতার সুবাদে ‘অতিমূল্যায়ন’ কিংবা অন্যায় আবদার না মানায় ‘অবমূল্যায়ন’ ইত্যাদি অনেক বড় মাত্রার অনৈতিকতা। অন্যায়-অনিয়ম দেখে নিশ্চুপ থাকাও আরেক ধরনের অসততা। প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দৃশ্যমান সততা ও নিষ্ঠা না থাকলে ঝরঝর করে ঝরে যাবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা। কর্তা হয়ে নিজে সৎ না হলে অধীন ব্যক্তিদের ওপর সততা আরোপ ব্যর্থ হবে। প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে চোখ ঝলসানো প্লাস্টিক পেইন্ট, এক্সিকিউটিভদের স্যুটেট-বুটেড ড্রেসিং কিংবা ক্লিন-শেভিং—সবই অর্থহীন, যদি আমাদের শ্রম, মেধা ও প্রতিভা হয় প্রাণহীন, ত্যাগহীন, গতিহীন।
মহাকালের হিসাবে খুব ক্ষুদ্র আমাদের পার্থিব জীবনের স্থায়িত্ব, যা শুধু উপভোগে ব্যয় না করে আমরা বর্ণাঢ্য কর্মময় করতে পারি। অবহেলায়, অদক্ষতায় একটি প্রতিষ্ঠানকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া সহজ, কিন্তু টেনে তোলা অনেক কঠিন। অদূর ভবিষ্যতে অটোমেশনের ঢেউয়ে রোবট দখল করে নেবে মানুষের স্থান। তবে কি মানুষের অদক্ষতা ও অক্ষমতার বিকল্প হবে রোবট? মানুষের মধ্যে রয়েছে স্রষ্টা প্রদত্ত অফুরন্ত সৃজনশক্তি ও কর্মশক্তি, কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের তাড়নায় তার নিঃস্বার্থ প্রয়োগ কম। কাজকে ভালোবাসতে হবে। ‘গতানুগতিক কর্তব্য পালন’ ও ‘কাজের প্রতি ভালোবাসা’ এক নয়। ক্লান্তিহীন কাজ করার অপূর্ব শক্তিময় ব্যক্তিরাই আনবে পরিবর্তন, সুশাসন।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
mmunirc@gmail.com