আমাদের কাছে কাজাখস্তান খুব পরিচিত দেশ নয়, কিন্তু অতি সম্প্রতি দেশটি সারা পৃথিবীর মতো আমাদের অনেকের নজর কেড়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কাজাখস্তানের হাজারো মানুষের রাস্তায় নেমে আসা আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকের মনে একধরনের চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। কাজাখ জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের এই অনুরণনের কারণটা অনুমেয়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রাথমিক কারণ হলেও কাজাখ মানুষের মনে আছে দীর্ঘ সময়ের অপশাসনজনিত পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।
কাজাখস্তান সংকট
মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান বিশাল দেশ, যা আয়তনে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম (ভারতের চেয়ে সামান্য ছোট)। মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের আবাসভূমি দেশটি জ্বালানি তেল, বিশেষ করে, প্রাকৃতিক গ্যাসে দারুণ সমৃদ্ধ। গ্যাসের প্রাচুর্যের কারণে সেই দেশের জনগণ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে তাঁদের গাড়ি চালান। তেল বা গ্যাসে সমৃদ্ধ অনেক দেশের মতো কাজাখস্তানেও এই গ্যাসের দাম বৈশ্বিক মূল্যের তুলনায় অনেক কম রাখা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকার এই ছাড় দেওয়া মূল্য থেকে সরে এসে মূল্য দ্বিগুণ করে ফেলে। এটাই মানুষকে প্রাথমিকভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। পুরো দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। প্রধান বাণিজ্যিক শহর আলমাটিও বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের শিকার হয়।
ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ খুব দ্রুতই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। কিন্তু মানুষ শান্ত হয়নি, মানুষ চায় সরকারের পতন। মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম—তোকায়েভ অসাধারণ প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিসভার লোকজন তাঁকে ‘ভুল বুঝিয়েছে’। এ ছাড়া তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবাইয়েভকে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদ থেকেও সরিয়ে দেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কাজাখস্তান স্বাধীন হওয়ার পর একনায়কতান্ত্রিক শাসন চলছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকার পর মানুষের আন্দোলনের মুখে প্রথম প্রেসিডেন্ট নাজারবাইয়েভ পদত্যাগ করেন, যদিও ভীষণ ক্ষমতাবান থেকে যান নাজারবাইয়েভ। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের ঘোষিত ক্ষমতা ছাড়াও অনেক ‘অঘোষিত’ ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। নতুন প্রেসিডেন্টও যে নাজারবাইয়েভকে সব রকমভাবে খুশি রাখতে চান, তার প্রমাণ দেন রাজধানী ‘আস্তানা’ এর নাম পাল্টে ‘নুরসুলতান’ রাখার মাধ্যমে।
কাজাখস্তানের জনগণ দেখল কাগজে–কলমে প্রেসিডেন্ট পাল্টেছে, কিন্তু ব্যবস্থা রয়েছে হুবহু একই। তাই তাদের ভেতর থেকে অসন্তোষ যায়নি। কিন্তু শুরুতে যেমন বলেছিলাম এবারকার এই আন্দোলন ঠিক স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ না–ও হতে পারে। এটা নাজারবাইয়েভ এবং তোকায়েভের পারস্পরিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলও হতে পারে। আবার নানা এলাকায় চীন-রাশিয়ায় এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও কাজাখস্তানে আছে কিছুটা উত্তেজনা-টানাপোড়েন। সাম্প্রতিক আন্দোলনে এই মিথস্ক্রিয়ার প্রভাবও থাকতে পারে।
আমাদের অনেককে হতাশ করে দিয়ে আন্দোলনটি ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো আমাদের আলোচনার জন্য সেটাই জরুরি। আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনার আগে এর কিছুকাল আগে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের আরেক অংশ বেলারুশের সত্যিকার, অসাধারণ এক গণ-অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলা যাক।
বেলারুশের ব্যর্থ গণ-অভ্যুত্থান
‘ইউরোপের শেষ স্বৈরশাসক’ বলে পরিচিত বেলারুশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় (২৭ বছর) ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট। তাঁর অধীন প্রতিটি নির্বাচন ছিল ভীষণভাবে কারচুপিতে পূর্ণ। আর সর্বশেষ যে নির্বাচনটি হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে, সেটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল অতীতের সব নির্বাচনকে। এই নির্বাচনটিতে সবচেয়ে বেশি কারচুপির প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ, এতেই ক্ষমতা ধরে রাখার পথের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল তাঁর জন্য।
সার্গেই তিখানোভস্কি অনলাইনে বিশেষ করে ভিডিও ব্লগিংয়ের মাধ্যমে বেলারুশের গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। ২০২০–এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। পরে এমন দেশগুলোতে যা হয়, প্রার্থিতা ঘোষণার পর তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। এরপর তিখানোভস্কির স্ত্রী সাভিতলানা তিখানোভস্কয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণা করেন।
লুকাশেঙ্কোর অপশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে থাকা মানুষ মুহূর্তেই একেবারেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন গৃহিণী তিখানোভস্কয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। কত মানুষ তাঁর পক্ষে আছে, সেটার প্রমাণ রাখার জন্য তিখানোভস্কয়া আহ্বান জানান, নির্বাচনের দিন ভোটাররা যেন তাঁর প্রতি সমর্থনসূচক সাদা ব্যান্ড হাতে পরে আসেন। ভোটের দিন সাদা ব্যান্ডের কারণে একেবারে স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছিল তাঁর পক্ষে জনস্রোত মাঠে নেমেছে। কিন্তু তিখানোভস্কয়া নন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন লুকাশেঙ্কো; সেটাও রীতিমতো ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে।
ভয়ংকর রকম কারচুপির নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে রাস্তায় নেমে আসেন জনগণ। রাজধানী মিনস্কে তো বটেই, পুরো বেলারুশে হাজারো মানুষ প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করেন। বিক্ষোভটি চলে কয়েক মাস ধরে। ইউরোপের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সরকার পতনের দাবিতে এত মানুষের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার উদাহরণ বিরল। কিন্তু না, প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো টিকে থাকলেন এবং এখন সেই আন্দোলন একেবারেই শেষ হয়ে গিয়ে তিনি দেশ শাসন করছেন একেবারেই নির্বিঘ্নে। তিনি রীতিমতো স্বপ্ন দেখছেন, ২০ বছর পর বর্তমানে ১৫ বছর বয়সী পুত্রের হাতে ক্ষমতা দিয়ে যাবেন। বেলারুশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হওয়ার ন্যূনতম বয়স ৩৫।
কাজাখস্তান বেলারুশের গণ-আন্দোলনের পটভূমি
কাজাখস্তান, বেলারুশে দীর্ঘকালীন কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ক্ষমতায়। নির্বাচন একেবারেই কারসাজিতে পূর্ণ। দেশগুলোতে দুর্নীতি সেই অঞ্চলের মানে, অনেক বেশি।
সেখানকার ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের দল এবং আরও কিছু এলিটের হাতে রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান সব ব্যবসা কুক্ষিগত। তাঁদের ব্যবসার স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় আইন প্রণীত হয়। শুধু সেটাই নয়, অপরাধ করেও দেশগুলোর বিচারব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারেন তাঁরা। এসব এলিটের সঙ্গে কোনো সংঘাতের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়া তো দূরে থাকুক, প্রচণ্ড হয়রানির শিকার হন তাঁরা।
দেশগুলোতে ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এসবই সেখানকার মানুষের মধ্যে ক্রমাগত ক্ষুব্ধতা তৈরি করেছে, যেটা তাদের একদিন রাস্তায় নামতে প্রলুব্ধ করেছে।
কাজাখস্তান, বেলারুশের আন্দোলন ব্যর্থ হলো যে কারণে
আন্দোলন শুরুর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) সদস্য হিসেবে কাজাখস্তান সংস্থাটির সৈন্য আহ্বান করে। তখন এই সংস্থা সৈন্য (অল্প কিছু বাদে প্রায় সবাই রাশিয়ান) পাঠিয়েছিল সরকারকে রক্ষা করার জন্য। এই আলোচনায় খুব জোরেশোরে আছে রাশিয়া। মূলত তার অনুগত তোকায়েভকে দিয়ে একটা লোক দেখানো আহ্বান জানিয়ে সৈন্য পাঠিয়েছে তার নিজের ইচ্ছায়। রাশিয়ান সৈন্যদের নেতৃত্বে জোট এবং কাজাখ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অন্তত ১৬০ জনের হত্যাকাণ্ড, কয়েক হাজার মানুষ আহত হওয়া আর কয়েক হাজার গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি আপাতত তোকায়েভের নিয়ন্ত্রণে আছে।
মজার ব্যাপার, এই সংস্থার অন্যতম সদস্য এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আর্মেনিয়া কিছুদিন আগেই নাগোর্নো কারাবাখ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে আজারবাইজানের কাছে প্রচণ্ড নাকাল হওয়ার পরও আর্মেনিয়াকে রক্ষার জন্য সেখানে সৈন্য পাঠায়নি সিএসটিও (পড়ুন রাশিয়া)।
এই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে গণতন্ত্রকামীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এবার বলা যাক। এই সমস্যার মধ্যেই সিএসটিও এর সদস্য দেশগুলোর (রাশিয়া, কাজাখস্তান, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান) সরকার প্রধানগণ এক ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে বসেন। এতে ভ্লাদিমির পুতিন সাফ জানিয়ে দেন—এই এলাকায় কোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হতে দেওয়া হবে না।
পুতিনের এই গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তই বেলারুশের অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ। বিক্ষোভকারীরা যখন বেলারুশের রাস্তায় নেমে আসেন, তখন প্রথম দিকে লুকাশেঙ্কো তুলনামূলকভাবে নমনীয় ছিলেন। তিনি বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলছিলেন, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। এরপরই তিনি রাশিয়ায় যান এবং পুতিনের ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে আসেন। তারপর নির্মমভাবে চড়াও হন বিক্ষোভকারীদের ওপর এবং শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
শুধু সেটাই নয়, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কোনো দেশ তাঁর মতো করে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেতে চাইলে তাঁকেও সর্বস্ব দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন পুতিন। ন্যাটোর সদস্য হতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনের ওপর সম্ভবত শিগগিরই একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে যাচ্ছেন তিনি। যেটা ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো ইউরোপ, এমনকি বিশ্বজুড়ে।
ইউরোপে যেভাবে রাশিয়া কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, এশিয়া এবং আফ্রিকায় সে একই ভূমিকা পালন করছে চীন। চীন এই ভূমিকা কীভাবে পালন করছে, আশা করছি, সেটা নিয়ে একটি পৃথক কলাম লিখব শিগগিরই।
এই বিশ্বে যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের এই বাস্তবতা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত গণজাগরণ তৈরি হলেও সেখানে চরম শক্তিশালী কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলোর প্রভাবে, এমনকি সরাসরি হস্তক্ষেপে সেই আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে। এটা শুধু আন্দোলনের ক্ষেত্রেই নয়, ঘটতে পারে নির্বাচনের নামে স্রেফ একটা প্রহসন করে সরকারের ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। কাজাখস্তান এবং বেলারুশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের সামনে এই শঙ্কাই তৈরি করে।
আবার ওদিকে গণতন্ত্রকামীরা যদি যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী হন, তাহলে এই শঙ্কাই আবার হয়তো তাঁদের ভূরাজনীতি বুঝতে শেখাবে, যেটা কাজে লাগবে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার পথে সঠিক কর্মকৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে। তাই পরিস্থিতি শুধু শঙ্কা এবং হতাশারও নয়, হতে পারে আশারও।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক