কাইয়ুম চৌধুরী, সবার কাছের মানুষ

২০১২ সালে ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল ভবনের সামনে (বাঁ দিক থেকে) কাইয়ুমপত্নী শিল্পী তাহেরা চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, শ্যালিকা জেবুন্নেছা ও লেখক সৈয়দ জিয়াউর রহমান
২০১২ সালে ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল ভবনের সামনে (বাঁ দিক থেকে) কাইয়ুমপত্নী শিল্পী তাহেরা চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, শ্যালিকা জেবুন্নেছা ও লেখক সৈয়দ জিয়াউর রহমান

আজ ৯ মার্চ কাইয়ুম ভাইয়ের জন্মদিন। বাংলাদেশের কৃতী সন্তান বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ৮৩তম জন্মবার্ষিকী।
প্রতিবারের মতো এবারও খুব ভোরে ঢাকা থেকে টেলিফোনে ওয়াশিংটনে ঘুম ভাঙালেন আমাদের কাইয়ুম ভাই। বললেন, ভাবতে পারো, আমার বয়স এখন ৮৩ বছর। বললাম, ৮৩ কেন, আগামী বছর আপনার বয়স ৮৪ হবে, আপনি শতায়ু হবেন। বললেন, আজকের দিনের সব কর্মকাণ্ডের কথা তোমাকে বলে নিই: তুমি তো ইন্টারনেটে ঢাকার খবরের কাগজ পড়ো। আজকের প্রথম আলোর ১০ পৃষ্ঠায় দেখে নিয়ো—মতি (প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান) আমার জীবনের নানা ভালো-মন্দ নিয়ে খুব সুন্দর একটি
লেখা দিয়েছে, তোমার ভালো লাগবে। তা ছাড়া আজ বিকেলে বেঙ্গলে (বেঙ্গল গ্যালারি) আমার জন্মদিন উপলক্ষে একটি বিশেষ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে এবং তোমার পরামর্শমতো সেখানে ৮৩টি ছবি দিয়েছি।
কাইয়ুম ভাই আরও বললেন, তার ওপর রাতে তোমার খোকন আপা (কাইয়ুমপত্নী চিত্রশিল্পী তাহেরা চৌধুরী) বেশ কিছু ভালো রান্নাবান্নার উদ্যোগ নিয়েছে। আর মামুন-লাকী (শ্যালক ও তাঁর স্ত্রী) বিশাল এক কেকের অর্ডার দিয়েছে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, কিন্তু ওর ছেলে আমাকে এসে বলে দিয়েছে। আমি এখন না জানার ভান করে বসে আছি।
জিজ্ঞেস করলাম, শিল্পীদের তরফ থেকে কিছু হচ্ছে না? বললেন, হ্যাঁ, আগামীকাল নবী (রফিকুন নবী), মাহমুদ, হাশেম খান, আলভী আর হাসনাত (কালি ও কলম সম্পাদক)—এরা সবাই মিলে ক্লাবে (ঢাকা ক্লাবে) সন্ধ্যায় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
পাঠক, এটুকু আমার কল্পনা, এ রকমই ছিল আমার প্রত্যাশা।
কাইয়ুম ভাই বেঁচে থাকলে তা-ই হতো। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর জন্মদিনের, অর্থাৎ আজ থেকে মাত্র তিন মাস আগে। আমরা সেদিন ওয়াশিংটনে বসে বাংলাদেশের টেলিভিশনে দেখছিলাম ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে কীভাবে মঞ্চে ঢলে পড়লেন আমাদের প্রিয় কাইয়ুম ভাই। আমাদের কল্পনার অতীত ছিল এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
কাইয়ুম ভাই যেদিন চলে গেলেন, সেদিনই মাত্র সাত-আট ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে। অনেক কথা হয়েছিল। বলেছিলাম, আপনার জন্মদিন উপলক্ষে বেঙ্গল গ্যালারিতে যে চিত্র প্রদর্শনী হবে, তাতে একটু চেষ্টাচরিত্র করে ৮৩টি ছবি দেবেন। বলেছিলেন, চেষ্টা করব। কাইয়ুম ভাইকে আরও বলেছিলাম, আমাদের অনুজপ্রতিম সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী বাস দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার মাত্র মাস দেড়েক আগে এসেছিল ওয়াশিংটনে। সে সময় জগ্লুল আমাকে বলেছিল, আপনাকে দেখলে কাইয়ুম ভাইয়ের চেহারা দেখতে পাই আর কাইয়ুম ভাইকে দেখলে আপনার চেহারা। আরও বলেছিল, ঢাকা ক্লাবে আপনাদের দুজনের আড্ডা দেখে আমি অবাক হয়েছি—দুই ভায়রার এ রকম সম্পর্ক আমি আর কোথাও দেখিনি।
কাইয়ুম ভাই শুনে হাসলেন। তারপর জগ্লুলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ-বেদনা প্রকাশ করলেন। অথচ তার মাত্র সাত-আট ঘণ্টার মধ্যে তিনিও চলে গেলেন জগ্লুলের মতোই আকস্মিকভাবে—পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ও অগণিত অনুসারীকে শোকসন্তপ্ত করে।
কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বৈবাহিক সূত্রে, আজ থেকে ৪৬ বছর আগে। তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। অবশ্য বিয়ের প্রায় বছর দশেক আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সব মিলিয়ে অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা।
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁকে যতটা জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি অত্যন্ত পরিশীলিত ও উঁচু মাপের একজন ভালো মানুষ। অসাধারণ মানুষ! চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর অনন্য প্রতিভা। দেশজ অপরূপ নিসর্গের পটভূমিতে তৈরি তাঁর চিত্রকলা। বিষয় ভাবনা ও অঙ্কনশৈলীর বিপুল বৈচিত্র্য, রঙের অপূর্ব ব্যবহার, প্রচ্ছদশিল্প ও গ্রাফিক ডিজাইনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে এই শিল্পে বিপুল প্রাণসঞ্চার—এসব সম্পর্কে চিত্রকলা অনুরাগীদের, বিশেষ করে বিদগ্ধজনমাত্রেরই ধারণা সুস্পষ্ট।
তবে আমাদের কাছে এবং কাইয়ুম ভাইয়ের পরিবার-পরিজনের কাছে এসবের ওপরে রয়েছে মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয়। তিনি ছিলেন হাসিখুশি মেজাজের, সহজ-সরল স্নেহবৎসল। কখনো কারও সঙ্গে রাগারাগি করতে কিংবা কলহ-বিবাদে লিপ্ত হতে দেখিনি আমরা তাঁকে। ঘরে-বাইরে নানা ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা-বিতর্ক নিয়ে প্রায়ই দেখা যায় বিতর্কে অংশগ্রহণকারীকে প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে। কিন্তু এ রকম ক্ষেত্রেও কাইয়ুম ভাইকে দেখেছি অসাধারণ ধৈর্য ধারণে, হাসিমুখে তিনি পরিস্থিতি সামলে নিতেন। তাঁকে দেখেছি আর্ট কলেজের (বর্তমানে ইনস্টিটিউট) তাঁর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, কর্মক্ষেত্রে নানা পরিবেশে, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সর্বত্রই সহজভাবে, সুন্দরভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। সম্ভবত এ কারণেই তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না, ছিল না কোনো শত্রু। মেলামেশা করেছেন যাঁদের সঙ্গে, তাঁদের সবার কাছ থেকেই পেয়েছেন অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
আমি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনে আসি ১৯৭৬ সালে। তার পরের বছরই কাইয়ুম ভাই আসেন প্রথম আমেরিকায়। সে সময় প্রায় চার মাস ছিলেন আমাদের সঙ্গে। ছবি এঁকেছেন অনেক। তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে ওয়াশিংটনে। পরে আরও দুবার এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহরে। তখন ঘুরে বেড়িয়েছেন ফিলাডেলফিয়া, পিটসবার্গ, নিউইয়র্ক আর কানাডার টরন্টোতে। এ সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাইয়ুম ভাই মেলামেশা করেন নানা অনুষ্ঠানে এবং অর্জন করেন তাঁদের বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধবসহ দেশ-বিদেশের সব পর্যায়ের মানুষের এই প্রাণঢালা ভালোবাসা নিয়েই চিরবিদায় নেন তিনি নশ্বর ভুবন থেকে। অসাধারণ ভালো মানুষ কাইয়ুম ভাই চিরকাল থাকবেন আমাদের সবার হৃদয়ে। তাঁর অম্লান স্মৃতি থাকবে চিরভাস্বর।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান: প্রবাসী সাংবাদিক।