কলড্রপ নামক গ্রাহক-ভোগান্তিতে লাভ কার

আজকাল প্রায়ই মুঠোফোনে কথা বলার সময় লাইন কেটে যায়। স্পষ্ট শোনা যায় না। ভেঙে ভেঙে কথা আসে। হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে যান মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা। মুমূর্ষু রোগীর খোঁজখবর নেওয়া কিংবা বিপদে-আপদে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলার সময় যদি এভাবে লাইন কেটে যায়, তাহলে মুঠোফোনের কি আর প্রয়োজনীয়তা থাকে? প্রযুক্তির ভাষায় এ সমস্যা ‘কল ড্রপ’ নামে পরিচিত।

সাধারণত, মুঠোফোন অপারেটরের সিগন্যাল যখন দুর্বল থাকে, তখনই ঘটে এই অনাকাঙ্ক্ষিত কল ড্রপ। এতে গ্রাহকেরা হয়রানির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, গত এক বছরে গ্রাহকেরা ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল ড্রপের শিকার হয়েছেন এবং এতে তাঁদের ১৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিটিআরসি কল ড্রপের প্রধান কারণ হিসেবে মুঠোফোন অপারেটরদের ফাইবার অপটিক কেব্‌লের সঙ্গে তাদের টাওয়ার সংযোগের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। গ্রামীণফোন এখন পর্যন্ত তার বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনের (বিটিএস) মাত্র ১২ শতাংশ ফাইবার অপটিক কেব্‌লে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এই হার রবির ক্ষেত্রে ১৮ এবং বাংলালিংকের ১৩ শতাংশ।

কল ড্রপ হওয়ার মূল কারণগুলো হলো নেটওয়ার্ক না পাওয়া, নেটওয়ার্ক কভারেজ এলাকার বাইরে চলে যাওয়া, টাওয়ার ক্যাপাসিটির বেশি মানুষ একই সময় একই এলাকায় চলে আসার কারণে নেটওয়ার্কে জট তৈরি হওয়া (ওভারলোডেড) ইত্যাদি। কল ড্রপের এ অবস্থার জন্য অন নেট কল ও অফ নেট কলও অনেকটা দায়ী। অন নেট হলো একই অপারেটরে কল দেওয়া, আর অফ নেট হলো ভিন্ন অপারেটরে কল দেওয়া। অর্থাৎ অন নেট ০১৭ থেকে ০১৭ নম্বরে কল দেওয়া আর অফ নেট ০১৭ থেকে ০১৫, ০১৬, ০১৮-এ কল দেওয়া বোঝায়। গ্রাহকেরা গত এক বছরে অন নেট কলে ৩৭ দশমিক ৬ কোটি মিনিট এবং অফ নেট কলে ১৪ দশমিক ৯৯ কোটি মিনিট কল ড্রপের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এগুলো সবই অদৃশ্যমান। অর্থাৎ বিষয়গুলো খুবই টেকনিক্যাল ও ডিজিটাল হওয়ায় সাধারণ ব্যবহারকারী তা বুঝতে পারেন না। আর এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো।

আবার ফোর-জি থেকে টু-জিতে নেটওয়ার্ক শিফট করলেও কল ড্রপ হতে পারে। এ ছাড়া লিফট, উঁচু ভবন, ভ্রমণের সময় বা আবহাওয়া খারাপ থাকলেও কল ড্রপ হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন জ্যামার, রিপিটার, বুস্টার ইত্যাদি ব্যবহারের কারণেও বিভিন্ন স্থানে কল ড্রপের ঘটনা ঘটে। প্রযুক্তিগত আরও যেসব কারণ কল ড্রপের জন্য দায়ী, সেগুলো হলো যে ব্যান্ডউইথ দিয়ে কথাবার্তা (ডেটা) আদান-প্রদান হয়, সেই ব্যান্ডউইথ/স্পেকট্রামের (জাতীয় সম্পদ) মূল্য অনেক বেশি। এ কারণে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম স্পেকট্রাম কিনে গ্রাহকদের বিতরণ করে।

উল্লেখ্য, সরকার ২০১৮ সাল থেকে স্পেকট্রামের মূল্য বিভিন্ন ব্যান্ডউইথভেদে ২ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে।

কল ড্রপের হার এত বেশি কেন, তা আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। বিভিন্ন দেশের টাওয়ারে নানা ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়। জিএসএম নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ৯০০ মেগাহাটর্জ ফ্রিকোয়েন্সি এবং এশিয়ান দেশগুলোয় ১৮০০ মেগাহাটর্জ (১ দশমিক ৮ গিগাহার্টজ) ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমাদের এই অঞ্চলে ব্যান্ডউইথ হিসাবের কোনো বালাই নেই। নেপালে ৪ কোটি ২৮ লাখ গ্রাহকের জন্য স্পেকট্রাম ব্যবহার করে ১২ মেগাহার্টজ। অথচ বাংলাদেশে ১ কোটি গ্রাহকদের জন্য স্পেকট্রাম ব্যবহার করছে মাত্র ১২৯ মেগাহার্টজ।

অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতি মেগাহার্টজে গড়ে ১২ লাখ লোককে কানেক্ট করছে। এই সংখ্যা নেপালে গড়ে ৩ লাখ এবং মিয়ানমারে গড়ে ৪ লাখ। কল ড্রপের বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য ৪০ আসনের শ্রেণিকক্ষে ১০০ জন ছাত্রের ভর্তি কিংবা ১০০ জনের জন্য রান্না করে ১০০০ জনকে দাওয়াত দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

আসলে পুরো প্রক্রিয়া একটি ডিজিটাল কারসাজি এবং শুধুই প্রতারণা। প্রতিনিয়ত কল ড্রপ যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে একদিন শুধু কল ড্রপই থাকবে, কথা বলা থাকবে না। যেমনটি হয়েছিল ল্যান্ডফোনের ক্ষেত্রে। ল্যান্ডফোন ব্যবহারকারীরা যখন কোনো সমস্যা নিয়ে টিঅ্যান্ডটি অফিসে যেতেন, তাঁরা বলতেন, ফোনের কেব্‌ল ইঁদুরে কেটে ফেলেছে, কেব্‌লের ভেতরে পানি ঢুকেছে; ডিমান্ড নোটের নামে বিশাল অঙ্কের টাকার লেনদেন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

মুঠোফোন প্রযুক্তি একটি প্রকৌশল–পরিকল্পনা ও মানদণ্ড মেনে করা হয়, যাতে গ্রাহকেরা নির্বিঘ্নে সেবা পেতে পারেন। বিটিআরসির কোয়ালিটি অব সার্ভিস প্যারামিটার অনুসারে, ২ শতাংশ কল ড্রপ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে গ্রহণযোগ্য, যা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এর বেশি হলেই তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং হলে গ্রাহকেরা তাঁদের অর্থ বা সমপরিমাণ ফ্রি টকটাইম ফেরত পাবেন। আসলে গ্রাহকেরা কিছুই ফেরত চান না, চান নির্বিঘ্নে কথা বলতে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কল ড্রপের এই জ্বালাতন থেকে যেন কোনোভাবেই রেহাই পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। কোনো কোনো অপারেটর দাবি করছে, প্রতি তিন থেকে সাত মিনিটের কল ড্রপের (অন নেট কলের) জন্য গ্রাহককে এক মিনিট ফ্রি টকটাইম দিচ্ছে।

সে হিসাবে গ্রাহকের টাকার মাত্র ২২ শতাংশ পরিশোধ করেছে তারা। এর মানে হলো ৫২ দশমিক ৫৯ কোটিবার কল ড্রপের জন্য মাত্র ১১ দশমিক ৬৬ কোটি মিনিট গ্রাহককে ফ্রি টকটাইম ফেরত দিয়েছে। তারপরও প্রতি মিনিটের সর্বনিম্ন কলচার্জ ০ দশমিক ৪৫ পয়সা হিসাবে গ্রাহকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ দশমিক ৪২ কোটি টাকা।

আসলে পুরো প্রক্রিয়া একটি ডিজিটাল কারসাজি এবং শুধুই প্রতারণা। প্রতিনিয়ত কল ড্রপ যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে একদিন শুধু কল ড্রপই থাকবে, কথা বলা থাকবে না। যেমনটি হয়েছিল ল্যান্ডফোনের ক্ষেত্রে। ল্যান্ডফোন ব্যবহারকারীরা যখন কোনো সমস্যা নিয়ে টিঅ্যান্ডটি অফিসে যেতেন, তাঁরা বলতেন, ফোনের কেব্‌ল ইঁদুরে কেটে ফেলেছে, কেব্‌লের ভেতরে পানি ঢুকেছে; ডিমান্ড নোটের নামে বিশাল অঙ্কের টাকার লেনদেন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

আজ কারও বাসায় ল্যান্ডফোন আছে বলে মনে হয় না। সরকারি অফিসে ল্যান্ডফোনে কল করলে কেউ রিসিভ করে কি না কে জানে। সে জন্য সেবার যে মনোভাব নিয়ে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো বাজারে এসেছিল, আজ তাদের অবস্থান কী, নিজেদের একবার প্রশ্ন করা উচিত। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই কোম্পানিগুলোকে সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় পরিণতি ল্যান্ডফোনের মতো এবং বিকল্প কোনো প্রযুক্তি চলে আসতে পারে সময়ের স্রোতে।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়