ইংরেজিতে একটি কথা বলা হয়, ‘হ্যান্ড অন হার্ট’। অর্থাৎ বুকে হাত দিয়ে বলুন। এখন আপনি বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, বাংলাদেশে বছরে আড়াই বা তিন লাখ টাকা আয় করেন এমন লোকের সংখ্যা কত? অর্থাৎ মাসে পঁচিশ হাজার টাকা বা তারও নিচে। আমি জানি আপনি বলবেন, এই যে করোনাকালে বেশ কিছু নিম্নবিত্তের আয় কমে গেছে, তার পরও এই সংখ্যা অনেক বিরাট। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পুলিশ যেমন নাকের ডগা দিয়ে আসামি ঘুরে বেড়ালেও খুঁজে পায় না, তেমনি কর কর্তৃপক্ষও কর প্রদানে সক্ষম লোকদের খুঁজে পায় না।
প্রখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ (বিসিজি) ২০১৫ সালের শুরুতে জরিপ করে দেখিয়েছে বাংলাদেশে বছরে ৬ হাজার ডলার বা ৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে পারে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ। তাদের মতে, সংখ্যাটি বছরে ১০ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রাথমিক পর্যালোচনায় জানা গেছে, বছরে ৩৫০০ ডলার বা ৩ লাখ টাকা আয় করে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ২০০৭ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন প্রধানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলাদেশে কর প্রদান করতে সক্ষম—এমন মানুষের সংখ্যা কত হতে পারে? উত্তরে তিনি জোরে বলেছিলেন ‘ন্যূনতম ১ কোটি’।
আমরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র এবং কর দিতে পারে না, এমন ধারণা দ্বারা প্রতারিত হচ্ছি। যখন আমরা ২ হাজার ৬৮ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় সম্পর্কে কথা বলছি, তখন বুঝতে হবে এ হিসাব প্রতি মাসে ৪০ মার্কিন ডলার উপার্জনে সক্ষম ব্যক্তি এবং একই সঙ্গে কোটিপতিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
পূর্বোক্ত ক্যাটাগরিভুক্ত মানুষ মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হলেও শেষোক্ত ক্যাটাগরিতে কেবল ১৫ লাখ মানুষ রয়েছেন। এমনকি কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের ৩ কোটি মার্কিন ডলারের ওপর সম্পদ রয়েছে এবং তাঁদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিজেই বলছে, ২ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। বিভিন্ন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রায়ই আসা-যাওয়া করা বিদেশি সম্পদ ব্যবস্থাপকদের মতে, এ সংখ্যা ১ লাখের বেশি। জমির বর্তমান বাজারমূল্য ধরলে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে, সন্দেহ নেই। সরকারের রাজস্ব সম্ভাবনার দিক থেকে এ সংখ্যা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক হলেও বাস্তবে রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে বেশ কম।
অনেক ব্যবসায়ীই নিজের আয় কম দেখিয়ে সব ব্যয় কোম্পানির হিসাবে দেখান। ঢাকা ও চট্টগ্রামের অ্যাপার্টমেন্ট মালিকদের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে ২-৩ কোটি টাকা লাগলেও সরকারের খাতায় ক্রয়মূল্য দেখানো হয় ৪০-৫০ লাখ টাকা। ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদ, কনসালটেন্সি ফি কিংবা অন্তর্মুখী বাণিজ্যিক রেমিট্যান্স বা ইনডেন্টিং ফি থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর আদায় করে, এমন লোকের সংখ্যা অনেক। তবে তাঁদের বেশির ভাগেরই চূড়ান্ত কর নিষ্পত্তির কোনো প্রমাণ মেলে না। আমাকে আয়কর নীতি বিভাগের একজন সদস্য বলেছিলেন, যাঁদের উৎসে কর কর্তন হয়েছে, তাঁদের যদি খুঁজে বের করে চূড়ান্ত করদায় নিষ্পন্ন করা যেত, তাহলেও হাজার হাজার কোটি টাকা কর আদায় বাড়ত।
আমাদের আদায়কৃত আয়করের বিরাট একটি অংশ আসে ব্যক্তি পেশাজীবী এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয় থেকে। আমাদের দেশে করপোরেট করহার কম হওয়া উচিত। কেননা অধিকাংশ দেশেই ব্যক্তি করহারের চেয়ে করপোরেট করের হার কম। এটি নতুন করপোরেট প্রতিষ্ঠান বিকাশে সাহায্য করে। অন্যদিকে করপোরেট করের উচ্চহার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য হতাশাজনক। আর করযোগ্য আয় সামান্য হলেও ব্যক্তিপর্যায়ে প্রত্যেকেরই করজালের আওতায় আসার আগ্রহ থাকা উচিত। কর প্রদান করুন বা না করুন, অন্তত প্রত্যেকেরই টিআইএন নম্বর থাকা আরও জরুরি।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষেরই প্রদর্শিত বা চিহ্নিত আয়ের চেয়ে ব্যয় বিশেষ করে ভোগব্যয় বেশি। তাই অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো রাজস্ব বিভাগকে সুপার স্টোর, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, প্রাইভেট হাসপাতাল, বিদেশ ভ্রমণ বা গাড়ির শো-রুম পর্যায়ে একটু বেশি নজর রাখতেই হবে। প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে আইওটির মতো উন্নততর প্রযুক্তি।
সবাই একমত, সরকারের উচিত করজাল বিস্তৃত করা এবং অধিক লোককে করের আওতায় আনা। আমি অবশ্য মনে করি, ব্যক্তিপর্যায়ে করহার একটু কম নির্ধারণ এবং নতুন উদ্যোক্তাদের কর ছাড় দেওয়া উচিত। অতীতে যে কেউ চাইলে ১০ কোটি টাকা জামানত দিয়ে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন এবং এ জন্য তাঁদের কোনো ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হতো না। বর্তমান কর-কাঠামোয় বাংলাদেশ কীভাবে অধিক বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করতে পারে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আমাদের অবশ্যই প্রতিযোগী বিনিয়োগ-আকাঙ্ক্ষী দেশগুলোর সঙ্গে করহারের সামঞ্জস্য বিধান করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আদর্শ করপোরেট কর ২৫ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু হঠাৎ করে এ করের হার কমানো হলে রাজস্ব আহরণের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ জন্য অবশ্যই ব্যক্তি বা কোম্পানি কর্তৃক মুনাফা লুকানো কিংবা সম্পদ অপ্রদর্শনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। করহার কমানোর আগে কর ব্যবস্থায় সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করাসহ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে রাজস্ব বিভাগকে। মন্ত্রী, এমপি, সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, গবেষণা সংস্থা কাউকেই করজালের বাইরে রাখা যাবে না। ‘কর অব্যাহতি’র সংস্কৃতিকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়। সামান্য হলেও কর দিতেই হবে। জনগণের জন্য কর দেওয়াকে করতে হবে এক সুখকর অভিজ্ঞতা। কর প্রশাসনকে যেতে হবে করদাতাদের দোরগোড়ায়।
মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সেসব দেশ রাজস্ব আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং এর ব্যবস্থাপনায় অধিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এ ছাড়া হিসাবরক্ষক ও অডিটররা যেন নৈতিকতা মেনে যথাযথভাবে কাজ করতে পারেন, সরকারকে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
যখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপের কথা বলা হয়, তখন আমার মতে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে বিভাজন থাকা উচিত নয়। কেননা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাথমিক এক জরিপে উঠে এসেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে অধিক কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিশ্চিত হয়নি। এর অর্থ, সেখানে করবহির্ভূত অন্য প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে, যা শেয়ারবাজারে নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তিকে আরও নিরুৎসাহিত করে তুলছে। একই সঙ্গে আমি মনে করি, যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে, কিংবা সহস্রাধিক ব্যক্তির কর্মসংস্থান দিচ্ছে, তাদের কর কমানো উচিত। কেননা এটি জনগণের সঙ্গে অধিক মুনাফা ভাগাভাগিতে অন্য কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে।
কর অব্যাহতির অন্য ক্ষেত্র হলো সিএসআর কার্যক্রম। সিএসআর কর্মকাণ্ডে কর অব্যাহতির সুযোগ সমর্থন করলেও সিএসআরের নামে যা হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমার গুরুতর প্রশ্ন বা আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে যথাযথ ও কার্যকর পাঠ্যক্রম প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী সম্প্রদায় বা পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় অধিক অর্থ ব্যয় করা উচিত। আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ও কৃষি গবেষণা, শিক্ষা এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। সিএসআরের অর্থ সেসব খাতেই ব্যয় হওয়া দরকার। সিএসআরের বিনিয়োগ কোথায় যাচ্ছে, এনবিআরকে সেটা তদারক করতে হবে এবং একই সঙ্গে একটি স্বাধীন এজেন্সির মাধ্যমে নিয়মিত বিরতিতে এর প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত। অডিট ফার্মগুলোর মাধ্যমে সিএসআরের কার্যক্রম কঠোর তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক দেশেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই আমাদের দেশেও তাদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ‘ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল’ গঠিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন তাদের এত দিনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি।
এনবিআরের অটোমেশনও গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডেটাবেজের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। এনবিআর ইতিমধ্যে কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। এ ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে সার্বক্ষণিক কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা, বিশেষভাবে ছুটির দিনগুলোয় কল সেন্টার কার্যকর রাখতে পারলে গ্রাহকনন্দিত হবে এনবিআর। রাজস্ব বিভাগের কর গোয়েন্দা সেলকে আরও সক্ষম ও কার্যকর করাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য হওয়া উচিত। বিশ্বায়নের এই যুগে ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং’ সেলকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। ‘ভ্যাট অনলাইন’ প্রকল্পের ব্যর্থতা বা আপাত-ব্যর্থতার আলোকে অতীতের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংস্কার প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনা সাপেক্ষে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের এখনই সময়।
আরেকটি বিষয় হলো রাজনৈতিক সুশাসন। দুর্বল রাষ্ট্র, জবাবদিহির অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির দেশে আকাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা দুরূহ কাজ বৈকি।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক।