ভারতে গরিব লোকেরা ২১ দিনের লকডাউনের মধ্যে খাবার পাবে কোত্থেকে? সরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়াতে পারে, তাহলে কাজ করার সুযোগ না পেয়ে গরিব লোকদের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক রিকশাচালক, নির্মাণ খাত ও পরিযায়ী শ্রমিকেরা এবং এ ধরনের আরও অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু শ্রমিক ইতিমধ্যে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের বিস্তার গোটা ভারতকে মানবিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ভূমিহীন কৃষকদের ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছে। ভারতে মোট ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ১৪ কোটি। উত্তর-ভারতের লাখ লাখ খেটে খাওয়া পরিবার গম কাটার কাজের ওপর নির্ভরশীল। এখন গম কাটার মৌসুমে লকডাউনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা সচল না থাকায় তাদের ঘাড়ে এখন ক্ষুধার দানব ভয়ংকর শ্বাস ফেলছে। ২১ দিনের লকডাউনে সময়সীমা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব গরিব লোকের পক্ষে কাজ ছাড়া হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থেকে নিজের ও পরিবারের খাবার জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, রিকশাচালক, নির্মাণ খাত, পরিযায়ী শ্রমিকসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু শ্রমিক ইতিমধ্যে খাবারের অভাবে ক্ষুধায় দিনযাপন করতে শুরু করেছে।
গত ২৬ মার্চ ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারাম ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্রকল্প’ (পিএমজিকেপি) থেকে যে ত্রাণ-প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তার অভিমুখটি সঠিক ছিল। কিন্তু এটি যত গর্জেছে তত বর্ষেনি। আসলে এটি এখন কাগুজে বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, পিএমজিকেপি তহবিলের ১৬ হাজার কোটি রুপি আগের ঘোষিত বরাদ্দ। আর মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের (এমজিএনআরইজিএ) ৫ হাজার ৬০০ কোটি রুপির মজুরি বৃদ্ধিসংক্রান্ত বরাদ্দের ঘোষণা গত ২৩ মার্চ রুরাল ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রেই উল্লেখ ছিল। মজুতকৃত অতিরিক্ত খাদ্য ছাড়ের সময় এর তথাকথিত আর্থিক মূল্য ধরে হিসাব করা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বিকল্প মূল্য (opportunity cost) তার থেকে অনেক কম। এটি আসলে পুরোনো হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির গোলমেলে ব্যাপার। এর জন্য অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে দায়ী করা যায় না। অধিকন্তু, এই অর্থ নেওয়া হচ্ছে নির্মাণশ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল থেকে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল নয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য আদর্শ ত্রাণ তহবিল কী হবে—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখব, এ ক্ষেত্রে বাজেট হবে প্রায় ১ লাখ কোটি রুপি। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর রেশন ও নগদ প্রদানের সমন্বয়ে সরকারের ত্রাণ প্যাকেজগুলো তৈরি ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। সরকার খাদ্যসামগ্রীর রেশন মাথাপিছু বরাদ্দ প্রথম তিন মাসের জন্য দ্বিগুণ করেছে, এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তারা আরও ভালো করেছে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের (পিডিএস) অধীনে রেশন ব্যবস্থা চালু করে খাদ্যসামগ্রীর তালিকায় ডাল যুক্ত করে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এমন অগ্রগতি সত্ত্বেও অনেক গরিব পরিবার পিডিএসের কার্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে। এর কারণ, জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা আইনের অধীনে ভারত সরকারের পিডিএস কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ধরা হয়েছে ২০১১ সালের প্রদেশওয়ারি জনমিতির ভিত্তিতে। প্রসঙ্গত, জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা আইন অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ ভারতীয় পরিবার খাদ্য সহায়তা পেয়ে আসছে। ফলে ২০১১ সালের সমীক্ষার পরিবর্তে ২০২০ সালের প্রক্ষেপিত জনমিতির হিসাবে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা হিসাব করে প্রতিটি রাজ্যের সরকার নতুন রেশন কার্ড ইস্যু করতে পারে। তা করা হলে সেসব গরিব পরিবারকে খাদ্যসামগ্রীর রেশনের সঙ্গে নগদ অর্থ পাওয়ার ব্যাপারটিও যেন অন্তর্ভুক্ত থাকে, তা বিবেচনায় রাখা জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর গরিব কল্যাণ প্রকল্পের (পিএমজিকেপি) কাঠামোতে নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থাটি বেশ দুর্বল। তার কারণ তিনটি। প্রথমত, বয়স্ক, বিধবা ও ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরা সামাজিক নিরাপত্তা থেকে যে ভাতা পান, তার পরিমাণ অতি সামান্য। ভারত সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রমে প্রতি মাসে মাথাপিছু মাত্র ২০০ রুপি করে দিয়ে আসছে। অঙ্কটি ২০০৬ সাল থেকে একই আছে। বেশ কয়েকবার বাড়ানোর জোর দাবি সত্ত্বেও তা বাড়ানো হয়নি। এটা মাথাপিছু কমপক্ষে ১ হাজার রুপি স্থায়ী ভিত্তিতে করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর জন-ধন যোজনা (পিএমজেডিওয়াই) প্রকল্পে সাত কোটি পরিবারের প্রতিটির দুজন সদস্যের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মহিলাদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, যাতে জরুরি ভিত্তিতে নগদ অর্থ পাঠানো যায়। সেটিতে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এই খাতে ৩১ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের (এমজিএনআরইজিএ) কার্ডধারীদের তালিকাটি ধরে কাজ করা একটি ভালো পন্থা হতে পারে। কারণ, এই তালিকায় প্রধানত গরিব পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পিএমজেডিওয়াই প্রকল্পের তালিকায় অনেক মধ্য শ্রেণির লোকজন ঢুকে পড়েছে; অনেক গরিব পরিবারকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
পিএমজেডিওয়াইভুক্ত মানুষদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল অসম্ভব তড়িঘড়ি করে; অব্যবহৃত থাকার কারণে অধিকাংশ অ্যাকাউন্ট স্থগিত হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ হিসাবগুলো ভুল জাতীয় পরিচয় নম্বর বা আধার কার্ড নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে অথবা অজানা অ্যাকাউন্টধারীর সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে কিংবা কখনো কালো টাকার নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের কার্ডধারীদের তালিকা পিএমজেডিওয়াইয়ের তুলনায় অনেকটা স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে উত্তীর্ণ ও গরিববান্ধব।
তৃতীয়ত, নগদ প্রদানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা অল্প। পিএমজেডিওয়াই প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীর গরিব কল্যাণ প্রকল্পের (পিএমজিকেপি) বরাদ্দকৃত ৩১ হাজার কোটি রুপি প্রায় ২০ কোটি গ্রহীতাকে প্রথম দফায় প্রতি মাসে ৫০০ রুপি করে ভাতা প্রদান করা হয়েছে তিন মাসের জন্য। একটি গড়পড়তা পরিবারের জন্য মাসে মাত্র ৫০০ রুপিতে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। সহায়তা প্রদান পদ্ধতি নিয়ে আছে আরও সমস্যা। সহায়তা প্রদানের কাজটি খাদ্যসামগ্রী দিয়েই হোক বা নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমেই হোক, আসলে বিতরণ পদ্ধতিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস), বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প ও নগদ অর্থ প্রদান—এই তিনটি কার্যক্রম যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে এবং এতে যদি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়, তবে একটি আদর্শ সামাজিক সুরক্ষায় আমরা বহুদূর পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হব। তবু কিছু মানুষের পরিস্থিতি এমন যে কিছুতেই যেন তাদের কানাগলি থেকে উদ্ধার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়ানোর জন্য ত্রাণব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভের প্রয়োজন। যদি কেউ খাবারের অভাবে ক্ষুধায় কষ্ট পায়, সে যেন জরুরি সেবার ফোন নম্বরে যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় যোগাযোগ করে নিজের অবস্থার কথা জানাতে পারে।
জরুরি সেবার ফোন নম্বর নিয়েও কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। পূর্ব ভারতের ওডিশা রাজ্যের ৩০টি জেলার মধ্যে কলাহান্ডি, বলাঙ্গির ও কোরাপুট জেলায় দুস্থ ও বঞ্চিতদের খাদ্য বিতরণকেন্দ্র ছিল। ২০১৫ সালের পর সরকার এই মূল্যবান কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ঝাড়খন্ড রাজ্যে কেউ খেতে না পেয়ে বিপদে পড়লে তার গ্রাম পঞ্চায়েতের (জিপি) জরুরি সেবা তহবিলের আওতায় ১০ হাজার রুপি পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। রাজস্থানেও একই পরিস্থিতিতে গ্রাম পঞ্চায়েতের তহবিল থেকে দুই বস্তা খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। অনেক রাজ্যেই কমিউনিটি কিচেন রয়েছে, সেখানে নামমাত্র মূল্যে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায়।
এসব ব্যবস্থার কথা বলা হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করা দরকার তার নমুনা হিসেবে। এ সময়ে এগুলো পথ দেখাতে পারে। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি কার্যকর জরুরি সেবা কার্যক্রম গড়ে তোলা যায়। রাজ্য সরকারগুলো এটি বাস্তবায়নের সবচেয়ে ভালো জায়গা। কিছু কিছু রাজ্য এরই মধ্যে এই কাজে নেমে পড়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে অবশ্যই এসব রাজ্যে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে। কেন্দ্র থেকে খাদ্যশস্য রাজ্যে পাঠানোর মধ্য দিয়ে এটির শুভ সূচনা হতে পারে। অর্থমন্ত্রী ত্রাণ-প্যাকেজে জরুরি সেবার কোনো বরাদ্দ রাখেননি। এই প্যাকেজের এটি একটি প্রধান দুর্বল দিক।
জরুরি সেবা চালু আছে—এমন রাজ্যগুলোতে শিগগিরই বরাদ্দ পাঠাতে হবে। সেটি করতে হবে দু-এক দিনের মধ্যেই,Ñকোনোভাবেই যেন সপ্তাহ না গড়ায়। মানুষের ক্ষুধার্ত থাকার ভয়াবহ সব গল্প এখনই লোকমুখে শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা বাড়ি ফিরতে না পেরে পথেঘাটে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে। তাদের কাছে রেশন কার্ড বা আধার পরিচয়পত্র চাওয়ার সময় এখন নয়। দেরি না করে বিনা শর্তে ও জরুরি ভিত্তিতে তাদের সরকারি সহায়তা দিতে হবে।
উল্লিখিত সবই রুজি-সহায়তা। এটি বলার প্রয়োজন নেই যে মানবিক ত্রাণসহায়তার দিকে থেকে আরও অনেক কিছুই করা দরকার, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিশুদের কথা বিশেষভাবে বলা দরকার। কারণ, ভারতের গ্রামে শিশুদের অঙ্গনওয়াড়ি ও বিদ্যালয়গুলো এখন বন্ধ রয়েছে। ফলে সেখানকার দৈনন্দিন সেবা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে এমজিএনআরইজিএ আবার গুরুত্বপূর্ণ হবে দুই দিক থেকে: তাৎক্ষণিক ত্রাণসহায়তা ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য। আশা করি, এই সপ্তাহে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে জরুরি ভিত্তিতে তারা নতুন সিদ্ধান্ত নেবে।
[ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অতিথি অধ্যাপক জঁ দ্রেজের ইংরেজি লেখাটি ছাপা হয় ভারতের দ্য ইকোনমিক টাইমস পত্রিকায়। আজ তাঁর লেখার শেষ কিস্তি ছাপা হলো]
[ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আহমেদ জাভেদ।]
আগের দুই পর্ব
ভারতে লকডাউনের বিপদ