কদিন আগে যখন ‘সামনে কঠিন সময়’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম, তখন মনে একটা ক্ষীণ আশাবাদ ছিল যে হয়তো তেমন একটা কিছু হবে না। ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ করে যেমন দিক পরিবর্তন করে, এ ক্ষেত্রেও তেমন হবে এবং বাংলাদেশ বেঁচে যাবে। আমরা অলৌকিকভাবে পার পেয়ে যাব। আরও ভেবেছিলাম, দ্রুত সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে এমন কিছু করা হবে, যাতে করে অল্পের ওপর ফাঁড়া কেটে যাবে এবং আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। এখন মনে হচ্ছে, আমরা অতি দ্রুত একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি।
দক্ষিণ কোরিয়ার অভিজ্ঞতা
গত বছরের ডিসেম্বরে গণচীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর জানুয়ারি মাসে চীনারা কোভিড-১৯ ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করে। এর পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এর মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করে। যেসব দেশ অনেকটা সফলভাবে এই ভাইরাস সামাল দিতে পেরেছে, তেমন একটি দেশ হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির মূল কৌশল ছিল স্বচ্ছতা, উন্মুক্ততা ও জনগণকে সম্পূর্ণরূপে অবহিত ও সম্পৃক্ত করা। দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অভিজ্ঞতাটি বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত ও অনুসৃত হচ্ছে। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাং কিউং হুয়া এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তঁারা প্রথমেই টেস্টিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। এ জন্য জানুয়ারি মাসেই সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট ও যন্ত্রপাতি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। দিনে ২০ হাজার এবং এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৬৮ হাজার টেস্টিং সম্পন্ন করা হয়েছে। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত আলাদা করে তাদের চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হয়েছে। এর ফলে, ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরোগ্যপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যার নিচে নামিয়ে আনতে এবং মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, তারা এটা করতে সক্ষম হয়েছে অর্থনীতির কাঁটা সচল রেখে এবং ইউরোপের মতো কোনো ধরনের লকডাউন ছাড়াই।
আমাদের পরিস্থিতি
অন্যদিকে আমাদের দেশে অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) অতি সীমিতসংখ্যক টেস্টিং কিট দিয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একদিকে বিদেশ প্রত্যাগতদের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকদের আলাদা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, অন্যদিকে সীমিত টেস্টিংয়ের কারণে আক্রান্তদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া টেস্টিংয়ের অভাবে প্রকৃত আক্রান্ত ব্যক্তি ও মৃত্যুর যথাযথ পরিসংখ্যানও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকের ধারণা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত এক ব্যক্তির ছেলে তাঁর পিতার অসুস্থতা, টেস্টিং ও চিকিৎসার যে বিবরণ দিয়েছেন, তা রীতিমতো হৃদয়বিদারক। ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত পরীক্ষণ কিটের অভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ঝুঁকির কথা বলেছেন। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে সবাইকে এমনকি সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে একজন হাসপাতাল পরিচালক জানিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সত্য ভাষণের জন্য এ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবীদের আস্থায় না আনতে পারলে কোনোভাবেই প্রাণঘাতী এ ভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব নয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বল্পমূল্যের টেস্টিং কিট তৈরির দাবি করলে কিছুটা সময় নিয়ে হলেও ঔষধ প্রশাসনের প্রাথমিক ছাড়পত্রের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এসব কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক–কর মওকুফ করেছে। অথচ অন্যান্য দেশ এসব কাজ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ভাগেই সমাধা করেছে। বিলম্বে হলেও এ জন্য ওষুধ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ধন্যবাদ।
বর্তমানের চ্যালেঞ্জসমূহ
আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় আমাদের এ মুহূর্তের প্রধান চ্যালেঞ্জ পাঁচটি। এক. এ ভাইরাস মোকাবিলায় সফল অন্যান্য দেশের মতো স্বচ্ছতার কৌশল নেওয়া এবং উন্মুক্ত নীতি অনুসরণ করে জনগণকে অবহিত রাখতে ও সম্পৃক্ত করতে হবে। এযাবৎ মন্ত্রীদের নানা বক্তব্য, আইইডিসিআরের ব্রিফিং এ ক্ষেত্রে মোটেই সহায়ক নয়। দুই. দ্রুততম সময়ে করোনাভাইরাসের টেস্টিং কিট দেশে আমদানি ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। তিন. বিদেশ থেকে আগত এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকদের আলাদা করে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব নিশ্চিত করে রোগের বিস্তার রোধ করা। তাঁদের সবাইকে পরীক্ষা করা এবং আক্রান্তদের চিহ্নিত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চার. চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষা গাউন, মাস্ক, গ্লাভস ও চশমা, নতুন আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির ব্যবস্থা ও হাসপাতাল সম্প্রসারণ করা। পাঁচ. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত রিকশাচালক, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং তাঁদের পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা।
এ ছাড়া সম্প্রতি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এমনকি আমেরিকা, কানাডার মোট উন্নত দেশেও গুরুতর আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেটরের অভাব দেখা যাচ্ছে। এটি একটি ব্যয়বহুল যন্ত্র। মেডিকেল যন্ত্রপাতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেডিট্রোনিক্স। উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক ইতিমধ্যেই ভেন্টিলেটরের উৎপাদন দ্বিগুণ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওমর ইশরাক একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান। সরকারি পর্যায় থেকে তাঁর সঙ্গে এখনই যোগাযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন।
এখনই সময়
ওপরে যে কাজগুলোর কথা বলা হয়েছে, তা অনেক আগেই আমাদের করা উচিত ছিল। এখন বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। সরকারি, বেসরকারি খাত সবাইকে রোগটির সংক্রমণ বিস্তার রোধ ও চিকিৎসার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সব বেসরকারি হাসপাতালে টেস্টিং ও চিকিৎসার অনুমতি দিতে হবে। তবে জনস্বার্থে টেস্টিংয়ের ফলাফল, আক্রান্ত ও আরোগ্যের ফলাফল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। বিদেশ প্রত্যাগত ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষা গাউন, মাস্ক, গ্লাভস ও চশমার নমুনা দ্রুত অনুমোদন এবং উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এ ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী কেবল দেশের জন্য উৎপাদন নয়, ভবিষ্যতে বিদেশেও তা রপ্তানি করতে পারবে। এর ফলে সাময়িক কর্মসংস্থানও হবে। এ ছাড়া বেসরকারি ও এনজিওগুলোর সব উদ্যোগকে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করতে হবে।
সবার সামনে সরকার
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবার সামনে থাকবে সরকার। আগেই বলেছি, এ জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। আগের লেখায় করোনাভাইরাস–পরবর্তী পুনর্বাসন ব্যয়সহ ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করা এবং এর অর্থায়নের উৎসের কথা বলেছিলাম। এখনো তা পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখি না। বিলম্বে হলেও প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। যার মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী–অধ্যুষিত সরকার এ খাতের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করবেন, এটা প্রত্যাশিত ছিল। বলা হয়েছে, কেবল কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, তা বলা হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম, এ মুহূর্তে রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ী, দিনমজুর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুনির্দিষ্ট প্রণোদনা থাকবে। এ ব্যাপারে ‘ঘরে ফেরা’ নামে একটি কর্মসূচির কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। কিন্তু যা আমাকে বিস্মিত করেছে, তা হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ফ্রন্ট লাইনে থাকা স্বাস্থ্য খাতের জন্য কোনো বিশেষ বরাদ্দ না থাকা। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, টেস্ট কিট, নতুন আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, হাসপাতাল সম্প্রসারণ ইত্যাদি কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন। বরাদ্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অপচয় ও আত্মসাৎকারীদের দ্রুততম সময়ে বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নাগরিকদের জীবন বাঁচানো সরকারের প্রথম দায়।
অনাকাঙ্ক্ষিত বিকল্প
করোনাভাইরাসকে পরাজিত করার জন্য আমাদের সামনে আর একটিমাত্র প্রাকৃতিক পথ খোলা আছে, তা হলো এর বিস্তার ঘটতে দেওয়া। জনসংখ্যার ৬০-৭০ শতাংশে এটা সংক্রমিত হলে যূথবদ্ধ অসংক্রমণ বা হার্ড ইমিউনিটির কারণে ভাইরাসটির বিস্তার বন্ধ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের চরম আর্থিক, সামাজিক, আত্মহননের মূল্য দিতে হবে। এবং তা হলে, জাতি আমাদের কাউকেই ক্ষমা করবে না।
আমরা আশা করব, তা ঘটবে না। মুক্তিযুদ্ধের মতো এ যুদ্ধেও আমরা বিজয়ী হব। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। এ লড়াইয়ে জিততে হবে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব