সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। রাস্তা ধু ধু করছে। একটা মানুষও নেই। হাঁটতে হাঁটতে মোড়ে এসে মনটা আরও খারাপ। এখানে যে শূন্যতা, তার হাহাকার বুকের ভেতর খামছে ধরছে। করোনার থাবা এ কী করেছে আমাদের! গোটা একটা দেশ, একটা জাতিকে আত্মরক্ষার শৃঙ্খলে আটকে ফেলেছে। সবাইকে ঘরে বসে বসে অপেক্ষা করতে হবে, কখন করোনার দুঃসময় কাটবে!
গ্রামবাংলার সেই চিরন্তন ছড়া:
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে...
সেই দুরবস্থার বাস্তবতা যেন ঢাকার বুকে। জনমানবহীন নগরের রাস্তাগুলো একেবারেই ফাঁকা। করোনার ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে সবাই ঠাঁই নিয়েছে ঘরের ভেতরে। এ যেন—মানুষ নেই রাস্তা ফাঁকা/ করোনা এল দেশে...
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মনে হলো আজ হেঁটেই অফিসে যেতে হবে। এমন সময় শাঁ করে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা এসে হাজির। কারওয়ান বাজার যেতে রাজি হলো। ভাবলাম সুযোগ নেবে। দ্বিগুণ না হলেও দেড় গুণ ভাড়া তো নেবেই। কিন্তু রিকশাচালক যৌক্তিক ভাড়াই নিলেন। আমার যেমন রিকশা দরকার, তাঁরও দরকার যাত্রী। ফসকে গেলে তাঁরও বিপদ। চাল কেনার তাড়া আছে। কথায় কথায় এটাই জানালেন। নইলে বেরোতেন না।
যেতে যেতে চিরচেনা নগরটাকে কেমন অচেনা মনে হলো। এই কিছুদিন আগেও জ্যামে বসে বসে বিরক্ত হয়েছি। অজান্তেই খেদ ঝেড়েছি, ‘এখানে মানুষ থাকে!’
অথচ আরাধ্য সেই ফাঁকা রাস্তাটাকে এখন বড় অসহ্য লাগছে। এই শূন্যতার মধ্যে রয়েছে অনেক মানুষের ঘরবন্দী জীবনের দীর্ঘশ্বাস। আতঙ্কের লুকানো হাহাকার। এটা কিছুতেই ধারণ করা যায় না। গতকাল সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়ে দেখি অনেক দোকানই বন্ধ। দু-চারটা যাও বা খোলা ছিল, লোকজনের বেজায় ভিড়। স্যানিটাইজারসহ নিত্যপণ্য কেনার ধুম চলছে। এক দোকানি বললেন, ‘যতক্ষণ মাল আছে, কাউকে নিরাশ করব না। মুশকিল হবে সাপ্লাই ঠিকমতো না পেলে।’
এক ক্রেতা বেশ খেদ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘এই সব হইল গজব। লোকজন যা অনাচার শুরু করছিল। ধর্ষণ আর ধর্ষণ। এখন বোঝো!’ আরেক ক্রেতা মজুরদারের একচোট বকে নিজেই বেশ কিছু জিনিস আগাম কিনে নিলেন।
করোনাভাইরাস বর্গী বা লুটেরা ডাকাতের মতো ঝটিকা ত্রাস নয়, একটা গোটা দেশ, বলা যায় বিশ্বজুড়ে মূর্তিমান আতঙ্ক। এর চাপে সবাই দিশেহারা। ভয় পেলে যে লয় এসে পড়ে, তা তো লুকানোর কিছু নয়। করোনা ঠেকাতে মানুষ যা পাচ্ছে, তা–ই খাচ্ছে। যে যা বলছে, তা–ই শুনছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ আবার থানকুনিপাতা ঝাড়েবংশে নির্বংশ করতে নেমেছিল। তুলসীপাতারও গুষ্টি উদ্ধার হয়েছে। তাদের কিছু বলে যে ভর্ৎসনা করবেন, সে সুযোগ কোথায়?
সুসভ্যের ঝান্ডাধারী আমেরিকাতেও চলছে এমন তাণ্ডব। সেখানে এখন আমিষ বাদ দিয়ে শাকসবজি আর পাতা খাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। রেস্তোরাঁয় এখন স্নোবল টারনিপ নামের একধরনের শালগমের শাকের বেশ চাহিদা। এর মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন করোনাকবলিত জনতাকে রক্ষায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ অনুমোদন করেছে।
আমাদের যে কী হবে, প্রশাসন আর সরকারই জানে। খেটে খাওয়া মানুষের অনেকেই এরই মধ্যে কাজ হারিয়ে বেকার। বিশেষ করে যাঁরা রোজকার মজুরি খাটেন, রিকশা-স্কুটার চালান। ট্রাক-বাসের চালক ও সহকারীরাও বেকার। দোকানপাটের কর্মীদেরও একই অবস্থা। লোকজন না থাকলে ফুটপাতের হকার বা রাস্তা ফেরিওয়ালাদেরও ব্যবসার বারোটা বাজবে। সব মিলিয়ে গোটা দেশে আয়-রোজগারের একটা জটাজাল তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে এসব মানুষের জন্যও একটা প্যাকেজ লাগবে।
ছড়ায় আছে—বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/ খাজনা দেব কিসে?
ক্ষয়ক্ষতির পাহাড় জমলে তখন বুলবুলি পাখিটা হয়ে যাবে করোনাভাইরাস।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের লাভের পাল্লা ক্ষতির দিকে হেলে পড়বে। পরিবহন দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে এর জেরও কম যাবে না। কাঁচাবাজার মালপত্রে ঠাসা থাকলেও লোকজনের সমাগম কম হলে বিক্রি কমে যাবে। কলকারখানায় শ্রমিকেরা হাজির না থাকলে, কলের চাকা না ঘুরলে শিল্প খাতেও লাগবে ধাক্কা।
কাঁচামালে যাবে বিশাল গচ্চা। এর মধ্যে দুধের খামারিরা জানিয়েছেন, দুধের খামারে এখন প্রতিদিন গড়ে ৫৭ কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি এক মাস গড়ালে ক্ষতি হবে ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এই বিশাল ক্ষতির ধকল কোনো ব্যক্তি বা দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে একা সামাল দেওয়া খুবই কঠিন।
এর মধ্যে পোশাক খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী মোটা অঙ্কের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এবার অন্যান্য খাতের দিকেও সরকারের সুদৃষ্টি পড়বে বলে আশা রাখি।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: লেখক,সাংবাদিক
shariful.bhuiyan@prothomalo.com