করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে। ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশ ছাড়া আরও ১৩টি দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে অব্যাহতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি বন্ধ রয়েছে।
দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। ৩০ মের পর পর্যায়ক্রমে সবকিছু খুলে দিলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি বারবার পিছিয়ে অবশেষে ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ এবং ২৩ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মার্চের শুরুতে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় সরকার আবারও স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত পিছিয়ে ২৩ মে নিয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, করোনার বর্তমান ঢেউ যদি দীর্ঘ বা তীব্র হয়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তে সরকারের অটল থাকা উচিত কি না।
এ কথা হয়তো সত্য যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশে করোনা সংক্রমণের হার আশঙ্কার তুলনায় কম। কিন্তু আমাদের জানা নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে সংক্রমণের হার কত হতো। ইউরোপে স্কুল খোলার পর করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবার স্কুল বন্ধ করতে হয়েছে। তবে সংক্রমণের এই বৃদ্ধি যে স্কুল খোলার কারণে হয়েছে, তার গবেষণাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য–উপাত্ত আছে বলে মনে হয় না। ধরুন, বাংলাদেশে যদি ফেব্রুয়ারিতে স্কুল খুলে দেওয়া হতো, তাহলে আমরা অনেকেই হয়তো করোনার বর্তমান বৃদ্ধির হারের সঙ্গে স্কুল খোলার একটা যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করতাম।
তবে করোনা যে সহজে বিদায় নিচ্ছে না, তা মোটামুটি অনুমেয়। জাতিসংঘও বলছে, মৌসুমি রোগ হিসেবে এটি পৃথিবীতে বিরাজ করতে পারে। বিশ্বগ্রামের অংশ হিসেবে তাই সারা বছর বাংলাদেশে অল্পবিস্তর করোনা রোগী থাকা অনেকটা স্বাভাবিক। আর তাই যদি হয়, তাহলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ থাকবে? তা নিশ্চয়ই নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তি। করোনা এখানেই বেশি আঘাত হেনেছে।
পুরো এক বছরের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি আমাদের তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এ ক্ষতি কলকারখানা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্র কিংবা বইমেলা বন্ধ থাকার যে ক্ষতি, তার মতো সহজে প্রকাশ করা যায় না। যেমন ধরুন, আমরা গত বছর লকডাউনের তিন মাসের অর্থনৈতিক ক্ষতির যে হিসাব করেছিলাম, তাতে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় আনা হয়নি। কেননা শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। আর জিডিপির ভিত্তিতে ক্ষতির হিসাব করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণই পাওয়া যাবে না। কারণ, কিছু কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছাড়া আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিসহ অন্যান্য লেনদেন যথারীতি করোনা–পূর্ব অবস্থায় আছে। তাহলে কেউ হয়তো বলতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছর বন্ধ থাকার ফলে তেমন তো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাই আরও কিছুকাল বন্ধ থাকলেই–বা কী হয়?
দেখুন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী। আর তাই দীর্ঘ এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়তো এখন আমরা পরিমাপ করতে পারছি না। তাই বলে এটা যে অনুপস্থিত, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। একটু ভাবুন তো, একটি স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়ে কীভাবে দীর্ঘ ১২ মাস পার করল। শহরে না হয় অনলাইনের কল্যাণে স্কুলের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা সংযুক্ত আছে। কিন্তু লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা গ্রামে বসবাস করে, তাদের কথা কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছি? বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানেরা হয়তো আর স্কুলেই ফিরতে পারবে না। অনেকেই হয়তো উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই মুঠোফোনসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়েছে। আর এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো একটু ভাবুন তো? তারা স্কুলে ফিরলেও তাদের শিক্ষার মান কী রকম হবে, তা–ও সহজেই অনুমেয়।
তাই আমরা অনেকেই বলে থাকি, একটু বেশি পড়াশোনা করে নিলে এসব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পড়ানো, পড়া এবং সর্বোপরি পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই হয়তো আমরা শিক্ষার বহুমুখী ইতিবাচক দিক নিয়ে কখনো ভাবি না। সন্তান ভালো জিপিএ পেলেই আমরা খুশি। সন্তান ভালো মানুষ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কেননা, জিপিএ-৫–এর মতো ভালো মানুষ পরিমাপ করার কোনো মাপকাঠি নেই। সমাজে তাই ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। জিপিএভিত্তিক ফলাফলমূলক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের আরও অন্ধ করে ফেলেছে। শিক্ষার বহুমুখী ইতিবাচক দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানুষের সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠার এটি প্রধান নিয়ামক। আর শিশু সামাজিকভাবে গড়ে না উঠলে সে যত বড় বিদ্বানই হোক না কেন, সংকীর্ণতার কূপমণ্ডূকে নিমজ্জিত থাকবে। প্রমাণ তো সমাজে ভূরি ভূরি। একটি শিশু লেখাপড়া না জানলেও সামাজিকভাবে যদি সে বেড়ে ওঠে, তাহলে সে কখনো সমাজ বা দেশের ক্ষতির কারণ হবে না।
দীর্ঘ এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে গড়ে না ওঠার ক্ষতি এবং মানসিক ক্ষতি বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তই মনে হয় যুক্তিযুক্ত। শিক্ষকদের যেহেতু করোনা টিকার আওতায় আনা হয়েছে এবং বেশির ভাগ শিক্ষকই ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ করেছেন, তাই স্কুল ও কলেজ খোলার বিষয়ে একটি বড় বাধা অপসারিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের করোনা টিকার আওতায় আনার জন্য নিবন্ধন শুরু হয়েছে। আশা করি আগামী এক মাসের মধ্যে তাদেরও টিকার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আর তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সব বাধা দূর হবে। তাই করোনার সংক্রমণ বাড়ুক অথবা কমুক, আমাদের উদাত্ত আহ্বান, মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকুন। আর মানুষের উচিত সরকারকে এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে উৎসাহিত করা। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কোনোক্রমেই আর গ্রহণযোগ্য নয়।
● ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক