মতামত

করোনায় দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের বাঁচানোর উপায় কী

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ২৪ লাখে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে পিপিআরসি ও বিআইজিডি ‘ট্রেন্ডস ইন কোভিড ইম্প্যাক্ট অন লাইভলিহুড, কোপিং অ্যান্ড রিকভারি’ শীর্ষক গবেষণা পর্যায়ক্রম করে যাচ্ছে।

আমরা কি নতুনভাবে দরিদ্র হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর শিশুদের অবস্থা সম্পর্কে জানি? বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব রয়েছে। তবে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং মাঠপর্যায়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জরিপ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে।

দারিদ্র্য শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। শুধু আয়ের ওপর ভিত্তি করে দারিদ্র্য নিরূপণ শিশুদের জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, দারিদ্র্যের সমাধান হলো আয় বৃদ্ধি করা। তবে আয় বাড়লেই যে শিশুর সামগ্রিক কল্যাণ হবে তা কিন্তু নয়, কারণ সেটা শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করা হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু তা কখনো শিশুর জন্য নেতিবাচক হতে পারে। যেমন মা-বাবার উপার্জন করার জন্য কিশোরী মেয়েটিকে বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে ছোট ভাই-বোনের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। শিশুশ্রমের কারণেও পরিবারের আয় বাড়তে পারে।

ব্রিস্টল পদ্ধতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার মাধ্যমে শিশুর বঞ্চনাকে বিশ্লেষণ করে। সেগুলো হলো বসবাসের স্থান, স্যানিটেশন, নিরাপদ খাবার পানি, তথ্য, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। শিশুরা যদি দুই বা ততোধিক মাত্রার বঞ্চনার শিকার হয়, তবে তাদের দরিদ্র বলে মনে করা হয়। পিটার টাউনসেন্ডের প্রস্তাব অনুযায়ী ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতির সূচনা, যা শিশু দারিদ্র্য বোঝা এবং পরিমাপের ভিত্তি তৈরি করেছে।

শৈশব জীবনের গঠনমূলক পর্যায়। মহামারি, অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে মা-বাবা বা অভিভাবক যদি উপার্জন করতে না পারেন, তাহলে শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। দারিদ্র্যের প্রভাব বড়দের ক্ষেত্রে স্থায়ী না–ও হতে পারে। কিন্তু এর ফলে যে ক্ষতি, সেটা শিশুদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। একজন বয়স্ক ব্যক্তি যদি কিছুদিন অল্প পরিমাণ খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং পরে পর্যাপ্ত খেতে পারেন, তাহলে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু অপুষ্টি, অসুস্থতা এবং শৈশবে অপর্যাপ্ত যত্নের কারণে শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি পরবর্তী সময়ে শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তা অপূরণীয়।

পিপিআরসি ও বিআইজিডির সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে শহরের বস্তিতে (২ থেকে ৮ শতাংশ) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে (২ থেকে ১৬ শতাংশ) জরিপের আগের দিন কমপক্ষে এক বেলা না খেয়ে থাকা পরিবারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারির সময় বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা মাংস, দুধ, ফল খেতে পারেননি। অবিলম্বে সমাধান করা না হলে এই পরিবারের শিশুরা অপুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠবে এবং তাদের সামগ্রিক বিকাশ ঘটবে না। তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী জীবন কাটানো এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতি ও সমাজ পুনর্গঠনের সময় শিশুদের নির্দিষ্ট চাহিদাকে স্বীকৃতি ও অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় এই মহামারির প্রভাব বর্তমান প্রজন্মকে দীর্ঘদিন ধরে বহন করতে হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পিছিয়ে যাবে। শিশুদের দারিদ্র্য মোকাবিলায় আমরা যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছি কি?

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ কমিটি বাংলাদেশের জন্য সর্বশেষ সমাপনী পর্যবেক্ষণে (অক্টোবর ২০১৫) নিম্নলিখিত বিষয়টি জানিয়েছে, কমিটি সুপারিশ করে যে দারিদ্র্য মোকাবিলায় এবং শিশুদের জীবনে শহর ও গ্রামের এবং সামাজিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। যারা বিশেষভাবে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে, সেই শিশু ও পরিবারগুলোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিতে হবে...।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে উপরিউক্ত সুপারিশটি আরও প্রাসঙ্গিক। টেকসই মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে শিশুদের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দেওয়ার বিকল্প নেই। সব জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা এবং এ-সংক্রান্ত আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো। যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে দরিদ্র পরিবারগুলোর ঝুঁকি হ্রাস করা প্রয়োজন।

শিশু অধিকার লেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন করা দরকার। শিশুদের ওপর সামাজিক সুরক্ষার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর উচিত তাদের দারিদ্র্য হ্রাস কর্মসূচিকে শিশু সংবেদনশীল করা। যে পরিবারগুলোয় বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। যেসব শিশু মা-বাবার যত্ন ছাড়া বেড়ে উঠছে এবং যারা প্রতিবন্ধিতা, দুর্গম এলাকায় থাকা, জাতিগত পরিচয় বা অন্য কোনো কারণে সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে আছে, তাদের সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে আনতে হবে।

সামাজিক সুরক্ষার পরিকল্পনায় শিশু, তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকদের মতামত শুনতে হবে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে তাদের ফিডব্যাক দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত; জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখে। সব জাতীয় জরিপে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেসব শিশু বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করা কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়তা করবে। শিশুদের দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বহুমাত্রিক দিক নিয়ে গবেষণা করা দরকার।

কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতি ও সমাজ পুনর্গঠনের সময় শিশুদের নির্দিষ্ট চাহিদাকে স্বীকৃতি ও অগ্রাধিকার দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় এই মহামারির প্রভাব বর্তমান প্রজন্মকে দীর্ঘদিন ধরে বহন করতে হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পিছিয়ে যাবে। শিশুদের দারিদ্র্য মোকাবিলায় আমরা যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছি কি?

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী