মতামত

করোনার দুঃসময়ে পুলিশের উদ্ভাবনী উদ্যোগ

করোনা নিয়ে জনসাধারণকে সচেতনতায় পুলিশের নানা উদ্যোগ প্রশংসিত হচ্ছে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

উন্নয়ন প্রকল্পের অব্যবস্থাপনার চিত্র নতুন কিছু নয়। অবকাঠামোর স্থান নির্বাচন, নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ এবং অবকাঠামো নির্মাণ সর্বত্রই অব্যবস্থাপনার চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। একটি জনকল্যাণমুখী অবকাঠামো নির্মাণে এগুলোর কোনোটির গুরুত্বই কম নয়। প্রকল্প প্রণয়নে স্থান নির্বাচন ও নকশা প্রণয়ন বিশেষ ভূমিকা রাখে। আর প্রকল্প প্রণয়নের একটি মৌলিক ধাপ হলো সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ। সাধারণত প্রস্তাবিত প্রকল্পের স্থান নির্বাচন, নির্বাচিত স্থানের উপযুক্ততা, জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং সামাজিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের সামগ্রিক জনকল্যাণে এই ধাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু মেগা প্রকল্প ছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে দীর্ঘকাল এই ধাপ অনুপস্থিত ছিল। যার ফলে প্রকল্প নির্মাণকালে জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা, জনকল্যাণমুখী না হওয়া এবং পরিবেশগত, সামাজিক ক্ষতিসহ নানা সমস্যার নজির আমাদের সামনে কম নয়। এতে নানা রকম সামাজিক কোন্দল তৈরি হতো, ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল দীর্ঘ হতো।

কোনো কোনো সময় দেখা যায়, বিলের মাঝখানে খালের ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মিত না হওয়ায় তা জনগণের কোনো কল্যাণে আসছে না। আবার কোনো কোনো সময় দেখা যায় পরিত্যক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা করার পরিবর্তে পরিত্যক্ত স্থাপনার আশপাশে খালি জায়গায় বা খেলার মাঠে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব সমস্যা দূরীকরণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাইকরণের ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন হলে একদিকে যেমন তা অধিক জনকল্যাণমুখী হবে, অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের বিলম্বকাল কমে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে সক্ষমতাসম্পন্ন উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাসঙ্গিক ইনস্টিটিউট বা বিভাগকে নিযুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে বিশেষ নজর না দিলে এখানেও সিন্ডিকেট চক্র গড়ে উঠতে পারে, যার কারণে প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞাচিত চিন্তার সুফল থেকে দেশ বঞ্চিত হতে পারে।

ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের এসব উদ্যোগ সারা দেশের সব থানায় কার্যকরভাবে চালু করতে পারলে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অন্যদিকে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে

২.

পুলিশের সেবার প্রতি আমাদের অনেকেরই আস্থা হয়তো তলানিতে। তবে পুলিশের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। এ ধরনের কিছু কার্যক্রম সম্প্রতি আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে একটি মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার সময় মসজিদভিত্তিক কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম আমার নজরে পড়ে। সিঙ্গাইরের একটি অ্যাগ্রো ফার্ম পরিদর্শন শেষে স্থানীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম খুতবা শুরুর আগে পুলিশের একজন সাব–ইন্সপেক্টর সিভিল ড্রেসে মাস্ক পরাসহ করোনা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদকসহ স্থানীয় যেকোনো আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম বন্ধে জনগণের সাহায্য কামনা করছেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যেকোনো প্রয়োজনে বিনা দ্বিধায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতা এবং সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য তিনি চমৎকারভাবে আজান ও ইকামত দিলেন। বিষয়টি আমার কাছে বেশ ব্যতিক্রমী মনে হলো। কিন্তু উদ্যোগটি ব্যক্তিগত না দাপ্তরিক, তা তৎক্ষণাৎ জানার সুযোগ হয়নি। পরে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে গিয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়। এটি ডিআইজি হাবিবুর রহমানের একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ এবং এ কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ কাজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য পুরস্কারও প্রদান করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগী।

সেগুনবাগিচায় ডিআইজি অফিস ভিজিটের সময় উপরিউক্ত বিষয়টি বিস্তারিত জানার পাশাপাশি পুলিশের আরও দুটো চমৎকার উদ্যোগ সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। একটি হলো সিসিটিভির মাধ্যমে ঢাকা রেঞ্জের ১৩টি জেলার ৯৬টি থানার কার্যক্রম সরাসরি মনিটর করা। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে পুলিশের একটি চৌকস দল সারাক্ষণ ওসির অফিস কক্ষ, কয়েদখানা, দর্শনার্থীদের বসার স্থানসহ সর্বত্র নজর রাখছেন এবং প্রয়োজনে নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এর ফলে থানায় অহেতুক হয়রানি বন্ধ ও কাজের স্বচ্ছতা আনা অনেকটা সহজ হয়েছে।

অন্য উদ্যোগটি হলো জিডি মামলা সেল গঠন করা। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি অফিসে একজন অতিরিক্ত ডিআইজির তত্ত্বাবধানে ১৩টি জেলার ৯৬টি থানার জিডির সার্বিক বিষয়ে মনিটর করা হয়। এ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন থানার জিডিসংক্রান্ত অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে জিডির বাদীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে জিডির অগ্রগতি জানাসহ অবৈধ আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। ফলে এসব থানায় জিডিসংক্রান্ত অবৈধ লেনদেন বন্ধসহ সার্বিক কাজের গতি আনা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে।

ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের এসব উদ্যোগ সারা দেশের সব থানায় কার্যকরভাবে চালু করতে পারলে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অন্যদিকে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। আমরা আশা করি, এসব কার্যক্রমের বিস্তৃতি ও সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুলিশ জনগণের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠবে।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়