করোনাভাইরাস: একটি ব্যাধির বিশ্বায়ন

হ্যানয়ের ব্যস্ত রাস্তা এখন নীরব
হ্যানয়ের ব্যস্ত রাস্তা এখন নীরব

একেই কি তবে বলা হয় ব্যাধির বিশ্বায়ন? ধারণা করা হচ্ছে, এক বাদুড় থেকে বনরুই হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে আজ বিশ্বজুড়ে মানুষকে শুধু আতঙ্কিতই নয় পুরো অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডকে স্থবির করে ফেলেছে। তাই এর মোকাবিলায় প্রথমেই আমাদের যে জিনিসটা বোঝা দরকার তা হলো, কোভিড-১৯ কোনো ব্যক্তিবিশেষের রোগ নয়, যা শুধু চিকিৎসায় ভালো হবে। এটি একটি সামষ্টিক রোগ। তাই একে যৌথ অংশীদারত্বের মোকাবিলা করতে হবে।

এরই মধ্যে অনেক দেশ, এমনকি আমাদের কাছের ভারত, পাকিস্তান, নেপালও তাদের রোগীদের নমুনা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে। যার দরুন বিজ্ঞানীরা বুঝতে চেষ্টা করেছে যে কি চরিত্রের ভাইরাস সে দেশে পাওয়া যাচ্ছে। এই বিশ্লেষণ করে জানা সম্ভব এই জিন বহনকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে কি ধরনের ওষুধ প্রায়োগ করা যায়। অন্যান্য দেশেও একইরকম জিন বহনকারী করোনাভাইরাস আছে কিনা এ তথ্য জানা থাকলে সে দেশকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার পথ সহজ করে দেবে। ইন্টারনেটেই সব দেশ তাদের করোনা রোগীর জিনোম সিকোয়েন্সিং শেয়ার করেছে। কিন্তু এখনো আমাদের দেশের কোনো রোগীর জিনোম সিকোয়েন্সিং–এর নমুনা পাওয়া যায়নি। এটি জানা খুবই জরুরি যে, কোন কোন দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের আক্রান্তদের নমুনার সাদৃশ্য আছে। আর তখনই আমাদের চিকিৎসকদের একটা সঠিক গাইডলাইন দেওয়া সম্ভব।

পৃথিবীতে যেকোনো ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। কখনো লেগে যায় দশকের পর দশক। সাধারণত কোনো অসুখ যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়ে না। তারা ওষুধটি বাজারে আনার আগে খুব হিসেব কষে গবেষণা শুরু করে। আর গবেষণা থেকে শুরু করে বাজারজাত প্রক্রিয়ার পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত জটিল, সময় সাপেক্ষ এবং রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। আর বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ নিয়ে এত হইচই এর সহজ কারণ একটাই, পশ্চিমা বিশ্ব নিজেই আজ এর দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত!

ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন আনার ঝামেলা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ধরেন, এটি বাজারে খুব চলছে কিন্তু কয়েক দশক পর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেল। ওষুধটি তখন বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হলো। কিন্তু তাতে দেখা যায় কয়েক বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। তাই আফ্রিকা আর এশিয়া এলাকার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলো, যাদের ক্রয়ক্ষমতা কম তাদের ব্যাধি নিয়ে উন্নত বিশ্বের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ একেবারেই কম।

বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়েই শুরুতে মেনে নেওয়াটা একটু কষ্টকর। এই যেমন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে দুনিয়াজুড়ে হাত ধোয়ার যে উপদেশ মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে, এই ধারণার যিনি প্রবর্তক সেই ডা. ইগনাস স্যামেলওয়াইজকেও এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য পাগলাগারদে মরতে হয়েছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তিনি ভিয়েনার হাসপাতালে কাজ করতেন। তখন তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, মাতৃমৃত্যুহার অস্বাভাবিক রকম বেশি। তখন তাঁর মনে হয়েছিল, এই মৃত্যু হচ্ছে সংক্রমণ থেকে। তাই তিনি তাঁর সহকর্মী চিকিৎসকদের বলেছিলেন, হাত পরিষ্কার করে তারপর চিকিৎসা করতে এবং ফলশ্রুতিতে মাতৃমৃত্যুর হার পরবর্তীতে ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। কিন্তু হাত পরিষ্কার করার পরামর্শে তাঁর সহকর্মীরা মারাত্মকভাবে অপমানিত বোধ করেছিলেন এবং এর বদলা নিতে তাঁর ওপর এত বেশি মানসিক অত্যাচার হয়ে যায়। তিনি পরবর্তীতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে শেষমেশ পাগলাগারদে মারা যান।

বুয়েনস এইরেসে সংক্রমিত এলাকায় খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে

ভাইরাস কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে। এটি অতি ক্ষুদ্র জৈব উপাদান মানে প্রোটিন, যা চারপাশে চর্বি দ্বারা আচ্ছাদিত জীবাণু হিসাবে বিবেচিত। আর করোনাভাইরাস মানুষের শ্বাসনালিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোষকে দখলে নিয়ে নিজের আরও লাখ লাখ সংস্করণ তৈরি করে ফেলে। আর এটি মারাত্মক এই কারণে যে, এর উপসর্গ প্রকাশিত হওয়ার আগেই সে আরও মানুষকে সংক্রামিত করে ফেলে। করোনাভাইরাসের প্রোটিন স্পাইকগুলো দেখতে রাজমুকুট এর মতো। তাই এর নামই করোনা, যার মানে মুকুট এবং সে এই মুকুট দিয়েই মানব কোষকে আক্রমণ করে। এই ভাইরাস ডেঙ্গু ও জিকা ভাইরাসের চেয়ে তিনগুণ বড় এবং এদের চেয়ে বেশি মরণঘাতী। কারণ সে অতিরিক্ত প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম। একবার এটি যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন সে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মতো হাজার হাজার কপি তৈরি করে ফেলতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যেই সংক্রামিত ব্যক্তির রক্তের প্রতিটি ফোঁটা কয়েক মিলিয়ন ভাইরাল কণা বহন করতে থাকে। তখন আস্তে আস্তে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে এবং এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরই ভাইরাসটির টিকে থাকা নির্ভর করে।

এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভাইরাসগুলোর নিজস্ব কোনো কোষীয় মেকানিজম না থাকায় তারা আমাদের দেহের ওপর ভর করে, তখন তাদের প্রোটিন আর আমাদের প্রোটিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য না করতে পারায় বেশির ভাগ চলতি ওষুধ যা তাদের ক্ষতি করতে পারে সেগুলি আমাদেরও ক্ষতি করতে পারে। এই কারণে না জেনে কোনো ওষুধ খাওয়াটা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। সম্প্রতি যে দুটো ওষুধ খাওয়ার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পরামর্শ দিচ্ছেন সেটা হলো হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন। সত্যিকার অর্থে এই দুটো ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই খাওয়া উচিত না। আর যারা এই দুটো ওষুধ বাসায় মজুত করেছেন তাঁদের এই অবিবেচনাপ্রসূত কাজের ফলে যাদের এই ওষুধটি সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন তাঁরা একটি বিশাল সংকটে পড়তে পারেন।

বিজ্ঞানীরা এখন এই স্পাইক প্রোটিনগুলো বোঝার মধ্যেই যে ভ্যাকসিন তৈরির রহস্য নিহিত এটা ধারণা করছেন। আর এটি পুরোদমে আলোর মুখ দেখতে সময় লাগবে। তাই আমাদের কাছে এই মুহূর্তে একটাই পথ খোলা জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ, যেমন পরীক্ষা করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের আরএনএ বদলে যাবে তখন এক সময়ের মরণঘাতী কলেরা আজকের মতো যেমন সাধারণ অসুখে বদলে গেছে, করোনাও একদিন হয়তো সাধারণ সর্দিকাশির ব্যাধিতে পরিণত হবে।

বিজ্ঞানী আর গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, এই নোবেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সম্ভাব্য কতগুলো উপায় আছে। প্রথমটি হলো, ওষুধ প্রয়োগ। দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যে চলতি বাজারে ৭০টির মতো ওষুধের ওপর পরীক্ষা চলছে যে, এটি কাজ করে কিনা কিংবা নতুন কোনো ওষুধের উদ্ভাবন করা যায় কিনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো এর কার্যকারিতা প্রমাণ করা এবং এই গবেষণা সময়সাপেক্ষ। আরেকটি হলো, অ্যান্টিবডি নির্ভর চিকিৎসা। ইতিমধ্যে জানা গেছে এক লাখ তিরিশ হাজারেরও বেশি অধিক লোক করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার মানে তাদের শরীরে এই রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এখন বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, এদের শরীর থেকে এই অ্যান্টিবডি নিয়ে অসুস্থ মানুষের শরীরের প্রবেশ করিয়ে সুরক্ষা তৈরি করানো যায় কিনা। তবে বিষয়টা খুবই সাময়িক কাজ করে মানে আপাতত ঠেকানোর কাজ করার মতো।

এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি আবার অরক্ষিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েই যায়। কিন্তু সতর্ক থাকবেন যাতে আবার আক্রান্ত না হোন। বিষয়টি কিন্তু একেবারে নতুন কিছু নয়, এক শ বছরেরও আগে জার্মান বিজ্ঞানী এমিল ভন বেহরিং ডিপথেরিয়া রোগের ক্ষেত্রে এটা সফলভাবে প্রয়োগ করে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। এটি ঠিক কাজে দেবে কিনা এর পরীক্ষা চলছে। কারণ ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি উল্টো ফল দিয়েছে। আর এটি সফল হলেও সুস্থ ব্যক্তি ১ থেকে বড়জোর ১০ জনকে অ্যান্টিবডি দান করতে পারবেন। কিন্তু এর সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে তিনি কি শুধু নিকটজনকে দান করবেন, না এর জন্য বিনিময় মূল্য প্রত্যাশা করবেন। নাকি জনস্বার্থে দিতে তিনি রাজি আছেন।

আরেকটি পথ, নতুন ভ্যাকসিন উদ্ভাবন। এই কাজটিই সফলভাবে করতে পারলে করোনা ভাইরাসকে নির্মূল সম্ভব। এই ভ্যাকসিন আবার দুই ধরনের। যার একটি প্রোটিন নির্ভর মানে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতি আর নতুন আরেকটি হলো জেনেটিক ভ্যাকসিন। এই জেনেটিক ভ্যাকসিন আবার নতুন প্রজন্মের ভ্যাকসিন, যা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে কাজে দিলেও মানবদেহে এর দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই সন্দিহান। এখনো মানবদেহে এর প্রয়োগের কোনো অনুমতি আজও মেলেনি। আর এটা ঘটলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে তা এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং–এর মাত্র দুই মাসের মাথায় মানবশরীরের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এক নতুন ইতিহাসই রচনা করেছেন বলা যায়। কিন্তু এরপরে এর কার্যকারিতা প্রমাণে সব ধাপ পেরোনোর ন্যূনতম সময় ধরে নিলেও ১২ থেকে ১৮ মাসের আগে তা সম্ভব নয়। তাও প্রশ্ন থেকে যাবে দীর্ঘ মেয়াদে এর কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?

ফাঁকা রাজধানীর নিউমার্কেটের দোকানগুলোও

আরেকটি রাস্তা হলো, হার্ড ইমিউনিটি। মানে সোজা বাংলায় হলো, বহু মানুষের মধ্যে এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে স্বাভাবিক নিয়মে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে যা একসময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পথ সীমিত করে ফেলবে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দিকে এ রকম পথেই হাঁটতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রাক্তন অক্সফোর্ডের ছাত্র বর্তমানে ইমপিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক নিল ফার্গুসন সোজা হিসেব করে বলে দিয়েছেন, এ পথে হাঁটলে দুই দেশেরই ৮১ ভাগ লোক আক্রান্ত হবে। আর শুধু যুক্তরাজ্যে কমপক্ষে ৫ লাখ লোক এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২২ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। আর সবচেয়ে করুন ব্যাপারটি হলো স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়বে। এই শুনে দুই দেশই তাদের নীতি থেকে সরে আসে। এই অধ্যাপকের গবেষণা দলটি আরও দুটি পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়েছে।

একটি হলো মিটিগেশন বা প্রশমন নীতি, যার লক্ষ্য হলো ধীরে ধীরে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা, চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা পূরণ এবং ঝুঁকির মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি তাদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। আরেকটি হলো সাপ্রেশন, মানে দমন নীতি, যার লক্ষ্য কঠোর বিচ্ছিন্নকরণ নীতি যেমন মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচার আচরণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে মহামারির টুঁটি চেপে ধরা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য সেই পরিস্থিতি বজায় রাখা। তবে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া দেখিয়েছে, দমন প্রক্রিয়া সম্ভব। তবে স্বল্পমেয়াদি। এটি অর্থনৈতিক কারণে দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। আর সে ক্ষেত্রে মহামারি আবার নতুন করে ফিরে আসে কিনা সে সুযোগও থেকে যাচ্ছে।

তাই নতুন এক তত্ত্ব এসেছে এই পর্যায়ে হ্যামার অ্যান্ড ডান্স। এর মানে হলো মহামারিকে আগে প্রচণ্ড আঘাত করতে হবে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে। এরপর একে সীমিত আকারে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যার মানে একসময় আস্তে আস্তে নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠিয়ে নিয়ে রোগী শনাক্ত, পরীক্ষা, আইসোলেশান আর কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে হবে। তবে এত কিছুর মূল লক্ষ্য কিন্তু একটাই। কালক্ষেপণ করা যাতে ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের জন্য সময় নেওয়া যায়।

স্কুল বন্ধ। তাই ঘরেই স্কুলের ব্যবস্থা। ছবিটি খার্তুমের

শনাক্তকরণ পদ্ধতি নিয়ে যে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে তা এই ক্রান্তিকালে সত্যিই অমূলক। কারণ, বর্তমানের পিসিআর পদ্ধতি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য (গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড) এবং সবচেয়ে নির্ভুল। এটি যেমন সত্য, তেমনি একটি সহজলভ্য অ্যান্টিবডি নির্ভর কীটেরও প্রয়োজন আছে। পিসিআর যেমন সরাসরি ভাইরাসটির উপস্থিতি প্রকাশ করে তেমনি অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ইতিপূর্বে আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা নিরূপণ করতে সহায়তা করে যা মহামারি মোকাবিলায় আমাদের এক বিশাল ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।

আরেকটি বিষয় হলো, এই ভাইরাসের চরিত্র। সাধারণ সর্দিকাশির ভাইরাসের মতো আশা করা হয়েছিল যে উষ্ণ আবহাওয়া এবং সূর্যের আলো ভাইরাসকে মেরে ফেলতে সহায়তা করবে। কিন্তু এখনো এর পক্ষে বড় কোনো প্রমাণ দাঁড় করানো যায়নি। বয়োবৃদ্ধদের রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা এমনিতেই কম থাকে বলে তারা এই রোগের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কম প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে তা যে মারাত্মক হয়ে উঠছে না এটি এখনো রহস্য। আবার একাধিকবার সংক্রমণের ঘটনার প্রমাণ মিলেছে তার মানে ভাইরাসটি একেবারে নির্মূল হয়নি, শরীরে আবার দানা বেঁধেছে। মানে আপনাআপনি গড়ে ওঠা প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজে দিচ্ছে না।


ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, মহামারির একটা রাজনৈতিক চরিত্রও আছে। চতুর্দশ শতকে ব্ল্যাক ডেথের মহামারির জন্য ইহুদিদের দায়ী করে নিপীড়নমূলক জাতিগত আক্রোশ গড়ে উঠেছিল। কলেরা মহামারির সময়ে শ্রমজীবী লোকেরা ভাবতে শুরু করেছিল যে ধনী ব্যক্তিরা তাদের হত্যার জন্য কলেরা আবিষ্কার করেছে। যার দরুন তারা ধনী গোষ্ঠী, হাসপাতাল এমনকি ডাক্তারদের আক্রমণ শুরু করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিটি আফ্রিকাতে আসার দরুন, সাদা মানুষেরা কালো মানুষদের ওপর এর দায়ভার চাপিয়ে এক নৃশংস বর্ণবাদের সূচনা করেছিল। ভারতবর্ষেও মহাত্মা গান্ধী এই ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। এই মহামারিতে শুধু উপমহাদেশের প্রায় ০১ কোটি ৮০ লাখ লোক প্রাণ হারায়। আর তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উপেক্ষা করেছিল, যার দরুন সৃষ্ট অসন্তোষ (অনেক গবেষণা মতে) ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মন্ত্রে লোকদের উজ্জীবিত করেছে। এখন করোনা ভাইরাসের আগমনও অনেক দেশে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলা উসকে দিয়েছে।

এর প্রাদুর্ভাবের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য যেমন দুশ্চিন্তা, অবসাদ আর শুচিবায়ুর মতো ব্যাপারগুলো জেঁকে বসতে পারে। তবে আমাদের দৈনন্দিন শিষ্টাচার যেমন যেখানে সেখানে ময়লা আর থুতু ফেলার মতো বদ অভ্যাসগুলো ঝেড়ে ফেলার এই সুযোগ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করার ফলে বিকট চাহিদার দরুন দামের যে ঊর্ধ্বগতি তা প্রান্তিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। তাই লকডাউন শব্দটি জাপান আর বাংলাদেশে এক নয়। রাষ্ট্রগুলো নিজেই বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। তাই দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আমি নিজে কতখানি শরিক হয়েছি—এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াটা জরুরি। শত্রু আমাদের অদৃশ্য তাই একসঙ্গে মোকাবিলা করাটা সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। ঠিক এইরকম সময়ে মানব সম্প্রদায়ের মনুষ্যত্বের দেবতুল্য রূপ আর পশুত্বের কদর্য চেহারাখানা বেরিয়ে আসে।

পশ্চিমের পুঁজিবাদের পূজারিরা সস্তা শ্রম নির্ভর প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য নিজের উৎপাদন ক্ষমতা এতটাই লোপ করেছে যে এক ডলারের ও কম দামের মাস্কের জোগানের জন্য প্রাচ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আর এতটাই আকালে পড়েছে যে খোদ মার্কিন মুলুকে কর্তৃপক্ষ একই মাস্ক অতিবেগুনি রশ্মি দিয়ে দূষণমুক্ত করে আবার ব্যবহার করার নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।

প্রায় ক্রেতাশূন্য রাজধানীর শপিং কমপ্লেক্সগুলো

মনে রাখতে হবে কোয়ারেন্টিন একটি নাগরিক দায়িত্ব, এটা জনগণকে বোঝানোটা যেমন রাষ্ট্রের জন্য জরুরি তেমনি জনগণের ও দায়িত্ব কোয়ারেন্টিন এ যাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন আচরণ না করা, যা তার জন্য অপমানজনক। এটি মানুষদের মধ্যে রোগের উপসর্গ লুকানোর অভ্যাস তৈরি করছে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদনের জন্য বাধ্য করার আইনের প্রয়োজনীয়তাও বিবেচনা করা যেতে পারে যেমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশেও বিদ্যমান। পাশাপাশি এই ঘটনায় একটি কথা পরিষ্কার পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের সিদ্ধান্তহীনতা মানুষকে নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি করে দিচ্ছে। সমস্যাটি এতই প্রকট যে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে ছয় হাজার পারমাণবিক বোমার মালিক তার রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সামান্য মাস্ক সরবরাহ করতে পারছে না। আর এতে প্রশ্ন উঠেছে যে, সামরিক কৌলীন্য না সুস্বাস্থ্যের আভিজাত্য—কোনটা বেশি জরুরি।


নাদিয়া সাফফুন: লেখক বর্তমানে এপিজেনেটিক্স নিয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল পর্যায়ে অধ্যয়নরত এবং কিংস কলেজ লন্ডন হতে ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট সায়েন্সে স্নাতকোত্তর।