গোটা বিশ্বের সব দেশের সব নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টি যখন করোনার দিকে, সবাই যখন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় করোনার মারাত্মক প্রভাব এবং অর্থনীতিতে এর ভয়াবহ চাপ সামলানো নিয়ে দিশেহারা, তখন এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো নিজেদের কার্যক্রমকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে মানুষ আগের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সক্রিয় এবং ইন্টারনেটের নানামুখী ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো অনলাইন কার্যক্রমে তাদের সব শক্তি-সামর্থ্য ঢেলে দিচ্ছে।
সবচেয়ে বড় বিপদের কথা হচ্ছে, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বহুমুখী হতাশা ও অস্থিরতা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি মানুষের উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে। গত ২৮ এপ্রিলে প্রকাশিত ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে (এরিক রোসান্ড, খালিদ, কোসের, লিলা লোগান) বলা হয়, আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে করোনাকালীন জটিলতা মোকাবিলায় সরকারগুলোর সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাবে জনগণের একটা অংশ চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে সহিংস উগ্রবাদ মোকাবিলায় আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
অথচ দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই উগ্রবাদ মোকাবিলার মতো জরুরি বিষয়টির ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশগুলোই ছাড় দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সংঘাতবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোন ইয়াকুবিয়া গত মাসে (মে, ৩) বলেন, চরমপন্থার জন্য আগে থেকেই নানাভাবে তৈরি হয়ে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে এখন আমরা খুব দ্রুতগতিতে এবং আরও গভীরভাবে চরমপন্থী মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্টার টেররিজম সমন্বয়ক গিলেস দ্য কেরশোভের আশঙ্কা, করোনাকালীন বিপর্যয়ের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে, তাতে সহিংসতা নিরোধের নিরাপত্তার দিকটি খুবই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ কোনোভাবেই এই ঝুঁকির বাইরে নয়। সর্বস্তরে ব্যাপক হারে দুর্নীতি, মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার পরিসর ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে ফেলা, সুশাসনের অভাব ও আইনের শাসন উপেক্ষিত থাকা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা এবং দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতার অভাব—সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের উগ্রপন্থা ছড়িয়ে পড়ার সঠিক ক্ষেত্র হিসেবে অনেক আগে থেকেই বিবেচিত হয়ে আসছে। আর এর সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনৈতিক অবস্থা তো রয়েছেই। করোনার কারণে এই চলমান সমস্যাগুলোই আরও ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে হতাশা ও ভীতি বেড়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অংশগ্রহণের হার বেড়ে যাওয়া বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজগুলোকে উগ্রপন্থীরা তাদের মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। তাদের এই কৌশলগুলোর অন্যতম হলো সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে ইসলামের প্রথম যুগের গৌরবগাথার বর্ণনা করা এবং মানুষকে ধারণা দেওয়া যে সেই যুগের সবকিছুই ছিল যথাযথ, কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না। উগ্রপন্থার প্রচারকেরা এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের সঠিক চর্চার চেয়ে মানুষের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই কাজটি করে থাকে। বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের অবস্থা, বাস্তবতা ও সমস্যা এবং তার সমাধানের উপায় যে ইসলামের প্রথম যুগের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন, সেই বিচার-বিশ্লেষণ থেকে তারা দূরে থাকেন।
বাংলাদেশের উগ্রপন্থীদের আরেকটি কৌশল হলো, তারা শুধু তাদের পছন্দের ইসলামকেই প্রকৃত ইসলাম বলে দাবি করে। আর এর বাইরের শান্তিপ্রিয় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘পাশ্চাত্য প্রভাবিত’ মুসলিমের লেবেল এঁটে দেয়। অথচ পশ্চিমা ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার বহু আগ থেকেই যে মুসলমানদের মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের চর্চা ছিল এবং মুসলিম শাসনামলে বহু প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ যে ইসলামের নানা চমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেসব ইতিহাসকে তারা উপেক্ষা করে।
উগ্রপন্থীদের আরেকটি সর্বাধিক ব্যবহৃত কৌশল হলো মুসলমানরা যে সবকিছুর ভিকটিম, তা প্রমাণের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, তাদের উদাহরণ টেনে এনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে মুসলমানরা পৃথিবীর সব দেশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। এখানেও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব ও নিজেদের মধ্যে হানাহানির বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকে।
একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে ভিকটিম প্রবণতা ঢুকিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত আমরা ভারতে দেখতে পেয়েছি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতারা এই কৌশল কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই একই কৌশল নানা সময়ে কাজে লাগান। এসবের পাশাপাশি করোনার আগমনের সঙ্গে যোগ হয়েছে কেয়ামতের আলামত তথা কেয়ামত–পূর্ব সময়ের আগমনের ইঙ্গিত দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা।
নিজের আদর্শগত অবস্থান মজবুত করতে বাংলাদেশের উগ্রবাদী গ্রুপগুলো সব সময়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এসেছে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে সহিংস চরমপন্থা রোধকল্পে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ৮২ ভাগ লোকই চরমপন্থাসহ বিভিন্ন অপরাধের দিকে ঝুঁকেছে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে। ওই অনুষ্ঠানে বিটিএলসির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের ৯ কোটি ৩০ লাখ ব্যবহারকারীর মধ্যে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন।
করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনে মানুষের সক্রিয়তা বাড়ায় বাংলাদেশেও উগ্রপন্থীরা এই মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুকে পেজে স্বনামে ও ছদ্মনামে বেশ কিছু জনপ্রিয় প্রচারক ও লেখককে খুঁজে পাওয়া যায়, যাঁদের কেউ কেউ এর আগে বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাঁদের যুক্ততার স্বীকারোক্তি পুলিশের কাছে করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে এখন আবার অনলাইনে সক্রিয় হয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলাকারীদের খুব সহজেই মানুষ ফেসবুক থেকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। তবে এখন উগ্রপন্থী প্রচারকদের বিশেষত্ব হলো, তাঁরা নিজেদের চেহারা ও পরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করে থাকেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তাদের সর্বশক্তি ব্যয় করছে করোনা মহামারি–সংক্রান্ত গুজব ও তথাকথিত সরকারবিরোধী সংবাদ নিয়ন্ত্রণে। এরই মধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রয়োগ করে কয়েক ডজন মানুষকে করোনাভাইরাস–সংক্রান্ত মন্তব্যের জের ধরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের মামুলি সমালোচনাকে প্রতিহত করার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হলেও উগ্রবাদীরা যথেষ্ট ভালোভাবেই তাদের উগ্র মতাদর্শ প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এটা পরিষ্কার যে নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সামাজিকভাবে উগ্রবাদীদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই এখন এই সমস্যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগের দাবি রাখে। করোনাকালে উগ্রবাদীদের তৎপরতার ব্যাপারে শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই। আর উগ্রপন্থাকে আদর্শগত অবস্থান দিয়ে মোকাবিলার জন্য জনপ্রিয় আলেমদের এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন নাগরিক-সামাজিক সংগঠন, জনপ্রিয় লেখকদেরও এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির কাজে সক্রিয় থাকতে হবে।
জান্নাতুল মাওয়া গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসের রিলিজিয়াস স্টাডিজের গবেষক এবং আন্তধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতিবিষয়ক কর্মী