আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে অভাবিত একটি ঘটনা ঘটে গত সপ্তাহে। করোনায় মৃত একজন ইহুদি ধর্মযাজকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সামাজিক দূরত্বের নীতি উপেক্ষা করে জড়ো হন হাজার হাজার অনুসারী। এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান কেউ কেউ। সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিউইয়র্কের মেয়র নিজেই। তিনি টুইটারে লেখেন: ইহুদি এবং সব সম্প্রদায়ের প্রতি আমার বক্তব্য স্পষ্ট। হুঁশিয়ারি জানানোর সময় শেষ, এরপর থেকে এমন কোনো জনসমাগম হলে পুলিশ সোজা গ্রেপ্তার করবে সবাইকে। নিউইয়র্ক পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ করোনায় আক্রান্ত শহর। মেয়র তাই সবাইকে এটিও বলেন যে এ পদক্ষেপ নেওয়া হবে করোনা ঠেকাতে এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে।
নিউইয়র্কের ইহুদি সম্প্রদায় মেয়রের হুমকিতে তবু খেপে ওঠে। নিউইয়র্কের একজন ইহুদি সিটি কাউন্সিলম্যান মেয়রকে বলেন যে তাঁর এ বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, একদল লোকের জন্য পুরো ইহুদি সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করা অনুচিত এবং বৈষম্যমূলক। কেউ কেউ আমেরিকায় সাম্প্রতিক কালে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অ্যান্টিসেমেটিজম উসকে দেওয়ার জন্য মেয়রকে অভিযুক্ত করেন। মেয়র পরে তাঁর হুঁশিয়ারিকে ‘টাফ-লাভ’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
করোনা উপেক্ষা করে ধর্মীয় সমাগম পৃথিবীতে আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে। কোথাও কোথাও এর পরিণতিও জানা গেছে। লন্ডন ও ঢাকায় ইসকন মন্দিরে হিন্দুদের জমায়েতে করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মালয়েশিয়া ও দিল্লিতে তাবলিগ জামাতে মুসলমানদের সমাগমে একই পরিণতি হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনার সংক্রমণ শুরুই হয় খ্রিষ্টানদের একটি গোত্রের প্রার্থনাসভা থেকে। জর্জিয়াসহ আরও কিছু দেশের ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ হয়েছে।
ধর্মীয় সমাগমের সঙ্গে মহামারির এ বিরোধ কিছুটা ব্যতিক্রমী। হাজার হাজার বছর ধরে রোগ–শোক ও ভীতির সময়ে মানুষ ধর্মের মধ্যে শান্তি ও আশ্রয় খুঁজেছে। প্রত্যেক ধর্মে রোগ-শোকের কালে বিশেষ প্রার্থনার কথাও বলা আছে। এই প্রার্থনা ধর্মীয় সমাগম করে করাটা প্রচলিত রীতি। অথচ করোনার মতো অতি ছোঁয়াচে রোগ এই প্রচলিত রীতিরই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও দয়ায় বিশ্বাস করে, তবু অনেকে করোনার আশঙ্কা অস্বীকার করতে চায়। যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস বেশি প্রবল, সেখানে এটি আরও বেশি ঘটছে। সমস্যা হচ্ছে আমরা অনেকে ধর্মপ্রাণ মানুষের এ অনুভূতিকে ততটা সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করি না, যেটি জাগতিক অনেক সমাবেশের ক্ষেত্রে করি।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
২.
আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাটি উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করতে পারি। সেখানে একজন ধর্মীয় সংগঠনের নেতার জানাজায় অসংখ্য মানুষের জমায়েত ঘটে। ঘটনার জের হিসেবে সেখান থেকে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে। এতটা প্রতিক্রিয়া আগে-পরে অন্য কোনো ঘটনায় ঘটেনি।
এ ঘটনার আগে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আতশবাজি অনুষ্ঠানে, খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তির সময়ে এবং পোশাকশ্রমিকদের ঢাকায় ডেকে এনে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সামাজিক দূরত্ব না মেনে বহু মানুষের সমাগম হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পরে এখনো পোশাকশ্রমিকদের কাজের জায়গায়, ধানকাটা সমাবেশে ও কাঁচাবাজারে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু এর একটি ঘটনাতেও কারও জন্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার জন্য পুরো জেলাটির লোকদের নিয়ে যে উপহাস ও গঞ্জনা হয়েছে, আর কোনো ঘটনায় তা সেভাবে হয়নি।
ধর্মীয় ও অধর্মীয় জনসমাগমের প্রতিক্রিয়ায় এখানে একধরনের বৈপরীত্য রয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি থাকতে পারে, বহু মানুষ মনে করতে পারে যে জীবন-জীবিকা বা বড় নেতার প্রতি আবেগ, ধর্মীয় আবেগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বহু মানুষ (আমার মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ) আবার উল্টোটাও ভাবতে পারে। রোজার মাসে তারাবিহর নামাজ ও জুমার নামাজে কঠোরভাবে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জনস্বাস্থ্যে প্রয়োজনীয়। বহু মানুষের কাছে আবার পোশাক কারখানাতেও একই নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক দূরত্ব প্রয়োজনীয় মনে হতে পারে।
আমার মতে, এ জন্য ধর্মীয় সমাগমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাটা আরও গ্রহণযোগ্য ও সহানুভূতিশীলভাবে করা উচিত। উদ্বুদ্ধ ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজটি করতে হবে। বহু ধর্মীয় গ্রন্থে মহামারিকালে চলাচল ও সমাগম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে, ইসলাম ধর্মেও আছে। এগুলো সারা দেশের ইমামদের বুঝিয়ে বলে তাঁদের মাধ্যমে প্রচার করলে (যেমন: মসজিদের মাইক দিয়ে) ভালো ফল মিলবে। অন্য ধর্মের ধর্মীয় নেতাদেরও একইভাবে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
৩.
এসবের পাশাপাশি অন্যান্য জনসমাগমেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত বৈষম্যহীনভাবে। নিতান্ত জীবিকার প্রয়োজনে পোশাক কারখানা বা অন্য কোথাও তা শিথিল করা হলে কঠোর কিছু শর্ত (যেমন শ্রমিকদের প্রথমেই করোনা টেস্ট, প্রয়োজনে মালিকের খরচে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখা, অসুস্থ হলে উপযুক্ত চিকিৎসা, মারা গেলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা) বহুল প্রচারিতভাবে আরোপ করা উচিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর আমার এটাও মনে হয়েছে যে জনপ্রিয় বা শীর্ষ পর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু যদি ঘটে, তাহলে কি জানাজায় আমরা লোকসমাগম এড়াতে পারব? লোকসমাগম হলে প্রবল নিন্দায় সোচ্চার হয়ে কিছু সরকারি কর্মকর্তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারব বা আদৌ কি চাইব? এর আলামত কি আমরা দেখি আমাদের সমাজে?
ব্রিটেনে আমরা তা দেখেছি। মৃত্যুর সন্নিকটে যাওয়ার পরও সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর জন্য সমাগম করে কোনো প্রার্থনা বা তাঁর হাসপাতালের সামনে কোনো ভিড় দেখিনি। নিউইয়র্কের মেয়র বা দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবল জনপ্রিয় সরকারপ্রধানের জীবনের আশঙ্কা দেখা দিলেও এমন সমাগম হবে বলে মনে হয় না। আমাদের এখানে এমন আশঙ্কা নেই, আমরা কি বলতে পারি? সেটা বলতে পারলে ধর্মীয় ব্যক্তির জীবনাবসানে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানুষের সমাগমকে আরও যৌক্তিকভাবে বারণ করা যাবে।
নিউইয়র্কে ধর্মীয় সমাগমে মেয়রের তীব্র প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা হয়েছে। একজন কাউন্সিলম্যান এটাও বলেছেন যে মেয়র কি লক্ষ করেছেন, এখনো কিছু পার্কে যাচ্ছে মানুষ, সেখানে কেউ কেউ সামাজিক দূরত্বও মানছে না। আমাদের এখানেও সমালোচিতদের পক্ষে এমন মুক্তভাবে মতামত পেশের সুযোগ দিতে হবে।
৪.
করোনার অভিজ্ঞতায় ধর্মীয় সমাবেশগুলোর বিকল্পও বিবেচনা করা যেতে পারে। ইসরায়েলে কয়েকজন ইহুদি ধর্মগুরু প্রযুক্তির মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল সমাগমের কথা বলছেন। ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাদি হামিদ বলেছেন, ইসলাম ধর্মে বেঁচে থাকাকে অন্য নীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেখানে অনাহারে মারা যাওয়ার উপক্রম হলে নিষিদ্ধ খাদ্য গ্রহণের অনুমোদন আছে।
করোনার অভিজ্ঞতায় ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর আশঙ্কার মুখে ধর্মীয় সমাগমকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ এসব বিবরণে রয়েছে। আমাদের ধর্মীয় পণ্ডিতেরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক