ভয়, ভীতি, আতঙ্ক, সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই আমরা করোনাকাল অতিক্রম করছি। কিন্তু মজার বিষয় হলো জানুয়ারি মাসের শেষ নাগাদ এই করোনাভাইরাসের নাম শোনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাদের সবচেয়ে বেশি অপদস্থ করা হয়েছে, তারা হলো এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাস করা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বাহক হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। চায়নিজদের সঙ্গে তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং বর্ণগতভাবে (রেস অর্থে) তারা মঙ্গোলয়েড হওয়ার কারণেই মূলত এ ধরনের প্রচার। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞ। জাতিসংঘ–ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ প্রতিবছর পালিত হলেও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সম্পর্কে শ্রদ্ধাপূর্ণ জানাশোনা আজও ঘটেনি।
চীনেই প্রথম এ ভাইরাস ঘর বেঁধেছিল বলে সে সময় থেকেই সেই জাতিবৈশিষ্ট্যের মানুষদের হেয় করার চেষ্টা চলেছে যেখানে-সেখানে। মনে পড়ে, ফেব্রুয়ারির শেষে যখন সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলাম, ফিরতি পথে দুবাই বিমানবন্দরে এক মঙ্গোলয়েড রেসের মেয়ে অনেক বড় সোফায় একা একা বসে ছিলেন। কেউ তাঁর আশপাশে বসেনি। পাশাপাশি বিমানের সিটে বসেছিলাম আমরা। একপর্যায়ের জানিয়েছিলেন, যদিও তিনি চীনা বংশোদ্ভূত, কিন্তু কোনো দিনই চীনে যাননি। তাঁর পরিবার অনেক আগেই চীন ছেড়েছে। তবুও বিমানবন্দরে তাঁর এই অভিজ্ঞতা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে। তাঁর কথা এবার বাদ দিয়ে নিজের কথাই বলি। সুইজারল্যান্ডে তখনো বরফ পড়ছিল, সেই ঠান্ডায় আমি এয়ারপোর্ট কয়েক দফা হাঁচি দিলাম। বাদামি বর্ণের একজন ঘন ঘন হাঁচি দিচ্ছে...সঙ্গে সঙ্গে এক শ্বেতাঙ্গ নারী বললেন, ‘আমি কি দূরে কোথাও দাঁড়াতে পারি?’
তখনো কিন্তু আমি বুঝিনি করোনার তেজ কত খারাপ হতে পারে; বরং এই অভিজ্ঞতাগুলো একধরনের বিরক্তি তৈরি করছিল। গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগীর অস্তিত্ব মিলল। প্রসঙ্গতই এই রোগীদের অনেকেই ইতালি থেকে আসার কারণে রাতারাতি ইতালিফেরতদের প্রতি আমাদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়ে গেল। শুরু হলো তাঁদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের ঢেউ। মানবিক সম্পর্কের নানা বিপর্যয়ের কাহিনি আমরা দেখতে শুরু করলাম। আমরা প্রতিবেশী চিনি না, আত্মীয়স্বজন চিনি না। এমনকি পরিবারের সদস্যদের প্রতিও কখনো কখনো হয়ে উঠেছি হিংস্র।
এসবই আমাদের আশপাশের চিত্র। এ পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষেরা তখনো নতুন লড়াই শুরু করেছেন ক্ষুধার বিরুদ্ধে, করোনার বিরুদ্ধে। এরই মধ্যেই পাহাড়ে তখন শুরু হয়েছে হামের প্রকোপ। মরেছে অনেক শিশুই। করোনার কোপ এই হামকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয়ভাবে। যেমন গুরুত্ব পায়নি করোনার সময়ে পানি–সমস্যায় থাকা পাহাড়ে হাত ধোয়ার বিষয়টিও। সরকার থেকেও বিষয়টি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে নিজস্ব উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে কীভাবে অল্প পানিতে হাত ধোয়া যায় এবং তারা নিজেদের পাড়া নিজেরাই লকডাউন করেছে এবং তাদের ভাষায় লিখে রেখেছে স্বাস্থ্যবিধি।
দুই.
যখনই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো, সেদিনই রাস্তায় গারো সম্প্রদায়ের মেয়েটির সঙ্গে দেখা। বয়স ২০ কি ২১ হবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব পারলারে চাকরি করতেন। বললেন, খুব শিগগির বাড়ি চলে যাবেন। সত্যি মেয়েটিকে বাড়ি চলে যেতে হলো। শুধু তিনিই নন, আস্তে আস্তে ঢাকা শহরের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শ্রমিকদের বাড়ি চলে যেতে হলো। দু-একজন পারলার–মালিকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, তারা দু–চারজন কর্মীকে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাচ্ছেন। কারণ, পারলার খুললে তাঁদের দরকার হবে।
তাঁরা ফিরে যান নিজ নিজ গ্রামে। সেখানে গিয়েও পড়েন অর্থনৈতিক ধাক্কায়। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অনেক মেয়েই এ ধরনের পার্টটাইম চাকরি করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ মিটাতেন এবং পরিবারকে সহায়তা করতেন। কিন্তু এই করোনার কারণে সেখান থেকে তাঁরা ছিটকে পড়েছেন। এর বাইরে অন্যদের মতো দূরদূরান্ত বাড়িতে ফিরে গেছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীরা।
সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিটিভিতে শিক্ষাদান করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ১৯৫৯ সালে কর্ণফুলী নদীর বুক চিরে চাকমা সম্প্রদায়ের এক লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে সারা দেশে বিদ্যুৎ দেওয়ার অঙ্গীকার করে যে বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল, সেই বিদ্যুতের আলোয় সারা দেশ ঝলমল করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের এখনো ৫৪ শতাংশ এলাকা এই বিদ্যুতের বাইরে। তাহলে এই টেলিভিশনে শিক্ষাদানও যে আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য, সেটাও সহজেই অনুমেয়। আমি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করছি না, বরং সবার জন্য সেটি কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেই বিষয়ে প্রশ্ন পাড়ছি মাত্র।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুরু হয়েছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। এখন কথা হলো, যখন আমরা সমাজের অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কথা বলছি, যারা কোনোভাবেই এই শিক্ষা কার্যক্রমে আসতে পারবে না। কারণ তাদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, স্মার্টফোন কিংবা অন্য কোনো ডিভাইস নেই, তারা নেটওয়ার্কের আওতায় নেই, কিংবা তাদের ডেটা কেনার সামর্থ্য নেই। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের কথা কেন আলাদাভাবে বলতে হবে?
তাদের কথা বলতে হবে আলাদাভাবেই। কারণ, বাংলাদেশের সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সেখানে কোনোভাবেই তাদের অনেকেরই বাড়তি ডেটাসহ স্মার্টফোন কেনার সমার্থে নেই। উত্তরবঙ্গের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অনেক শ্রমিকই কাজ হারিয়েছে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের মধ্যে একটি প্রবণতা দৃশ্যত তাদের সংস্কৃতিকে আলাদা করে। তারা খুব সহজে ত্রাণ বা সহযোগিতা চায় না। তাই তাদের মধ্যে ভিক্ষা করে—এমন লোক পাওয়া খুব কঠিন।
এবার আসি শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার প্রসঙ্গ। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শুনেছি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্য তালিকা প্রস্তুত করেছে। সেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা জায়গা পাবেন কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা পেলেও হয়তো চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থীর নাম দেওয়ার মধ্য দিয়ে বলা হবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদেরও সহযোগিতা করা হয়েছে।
এখন আসি পাহাড় প্রসঙ্গে। আমরা সবাই জানি যে ২০০৮ সালে পাহাড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ দেওয়া হয়। এর আগপর্যন্ত যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে পাহাড় হলো ‘ক্রাইম জোন’, এ জন্য সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক দেওয়া যাবে না। অথচ কে না জানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অপরাধ হয় খোদ ঢাকা শহরে। এই দোহাই দিয়ে কিন্তু ঢাকা শহরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়নি। এখনো পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চল ফোনের নেটওয়ার্কের বাইরে। সেখান হয়তো দেখা যায় কোনো টিলার ওপরে গেলে নেটওয়ার্ক আসে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই পাহাড়ে অনেকেরই স্মার্টফোন আছে, কিন্তু সেই ফোন নিয়ে নেটওয়ার্ক খুঁজতে দৌড়াতে হবে এখান থেকে ওখানে। করোনাকালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থী এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অন্য অধিবাসীদের জীবনের বাস্তবতা আলাদাভাবেই দেখতে হবে, এ বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দরকার।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail. com