পৃথিবীর প্রায় সব দেশই কমবেশি করোনাভাইরাসজনিত বিপদের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে এ সংকটের মধ্যেই দেখা দিয়েছে বন্যা, যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বন্যা সমস্যা বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে এ বছরের বন্যা পরিস্থিতি খুবই অন্য রকমের। করোনা ও বন্যার মধ্যেই পড়ে গেছে কোরবানির ঈদ। ঈদ উৎসব শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নয়। শুধু নতুন কাপড়চোপড় পরা ও ভালো খানাপিনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। করোনা রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে আঘাত হেনেছে। করোনা, অতিবৃষ্টি ও বন্যা গবাদিপশুর খামারিদের জীবনে দেখা দিয়েছে অভিশাপের মতো এবং চামড়াশিল্পে দেখা দেবে সংকট। জাতীয় অর্থনীতিকে করবে ক্ষতিগ্রস্ত।
দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা এখন বন্যাকবলিত। পদ্মাপারের মানুষ হিসেবে বন্যার কষ্ট ও ভোগান্তি আমি দেখেছি শৈশব-কৈশোরে। বন্যার শুরু ও শেষে হতো নদীভাঙন। কত মানুষের বাড়িঘর, গাছপালা নদীতে বিলীন হয়ে যেত। হাজার হাজার মানুষ হতো সর্বস্বান্ত, পথের ভিখারি। ভুক্তভোগী বলে বন্যা ও নদীভাঙন আমাকে বিচলিত করে। এখন টেলিভিশনে দেখে কষ্ট পাই। আমার প্রথম বন্যার স্মৃতি ১৯৫০ সালের। তারপর ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬-এর বন্যা। শুধু বাড়ির উঠানে কোমরসমান পানি নয়, ঘরের ভেতরে হাঁটুপানি। খাটের ওপরে চৌকি, তার ওপরে বসবাস। ঘরের মধ্যে কিলবিল করত মাছ, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি। কাজের লোকেরা মাটির আলগা চুলায় মাচায় বসে রান্না করত। অল্প–স্বল্প রান্না হতো বিছানায় স্টোভে।
এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য ছিল বাঁশ ও তক্তার সাঁকো। গরুগুলোর কষ্টের সীমা ছিল না। কুকুর, বিড়াল সাঁতরে খড়ের ঢিবির ওপর গিয়ে বসে থাকত। নৌকা, ডিঙি তো ছিলই, কলাগাছের ভেলাও তৈরি করা হতো। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল, কেউ মারা গেলে তাকে দাফন বা দাহ করা যেত না। কোনো রকমে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হতো। আমাদের ঘর থেকে সাগরের মতো বিস্তীর্ণ ও উত্তাল পদ্মার ওপারে দেখা যেত রাতে গোয়ালন্দ ঘাটের বাতি। ভরা বর্ষা ও বন্যার সময় মনে হতো এ পৃথিবীতে আকাশ, পানি ও নানা আকারের নৌকা ছাড়া আর কিছু নেই।
পঞ্চাশের দশকের কথা মনে আছে। যৎসামান্য রিলিফের চাল হতদরিদ্রদের জন্য সরকার দিত। মহকুমা সদর থেকে বড় নৌকায় সে চাল এনে আমার বাবাকে দেখেছি গরিব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিতরণ করতে। কেউ দূর থেকে সাঁতরে নিতে আসত বার্মা থেকে
আমদানি করা চাল। মর্মান্তিক দৃশ্য। শুধু চাল সেদ্ধ করে খেয়ে বেঁচে থাকত মানুষ। এখন অবশ্য পরিস্থিতি সে রকম ভয়াবহ নয়।
চার মাস পর কয়েক দিন আগে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম ঢাকা ও মানিকগঞ্জের বন্যা–উপদ্রুত এলাকা দেখতে। ২৫-৩০ বছর আগে এখনকার মতো আবহাওয়া ও বন্যার পূর্বাভাস ছিল না। পূর্বাভাসের কারণে এখন মানুষ সতর্ক হয়, ফলে ক্ষয়ক্ষতি হয় অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু দুর্ভোগ কম নয়। ষাটের দশক থেকে নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়, স্বাধীনতার পর তা ব্যাপকভাবে দেওয়াতে অনেক এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সম্ভব হচ্ছে। তবে উপকূলীয় এলাকায় যেমন আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে তা নেই। বহু মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি উঠেছে।
এক বছর আগে যদি গবাদিপশুর খামারিরা জানতেন যে করোনা মহামারি দুনিয়াকে বিপর্যস্ত করে দেবে, তাহলে তাঁরা সেইমতো ব্যবস্থা নিতেন। এমন বন্যা হবে, তা-ও তাঁরা অনুমান করেননি। তাহলে হয়তো তাঁরা এতটা বিনিয়োগ করতেন না। গত বছর আমি গরুর খামারি ও কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের কাঁদতে দেখেছি। ভেবেছিলাম ভবিষ্যতে অমনটি আর হবে না। নদীপথে গরু পারাপার করতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে বহু গরু মারা গেছে। সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক খামারি।
দেশি খামারিদের স্বার্থে গরু আমদানি কমানোর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। কিন্তু চোরাচালানিরা বসে নেই। টেলিভিশনে দেখেছি গরু চোরাচালানের দৃশ্য। যেভাবে কলাগাছের সঙ্গে বেঁধে খরস্রোতা নদীতে সীমান্তের ওপার থেকে গরু আনা হচ্ছে, তা শুধু বেআইনি অপরাধ নয়, চরম নিষ্ঠুরতা। চোরাচালানিরা খামারিদের ক্ষতি করছে, জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এখন আসছে গরু, কোরবানির পর হবে কাঁচা চামড়া চোরাচালান। কাঁচা চামড়ার দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা বা ড্রেনে ফেলে দেওয়া যেমন ক্ষতিকর, চোরাচালান হওয়াও ক্ষতিকর। বিশ্বব্যাপী এই দুঃসময়ে আমরা আমাদের একটি টাকার সম্পদও নষ্ট হতে দিতে পারি না। পাটশিল্পের মতো চামড়াশিল্প ধ্বংস হোক, তা সহ্য করা যায় না।
বিভিন্ন এতিমখানা ও সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করে। করোনার মধ্যে দেখা গেছে, করোনা রোগীর লাশ সৎকারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, মারকাজুল ইসলাম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান প্রশংসনীয় কাজ করছে। এসব মানবকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে কোরবানির পশুর চামড়া দান করা উচিত। চামড়া ব্যবসা অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। এসব বিষয় কোরবানির ঈদের দুই মাস আগেই বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলা যায়, করোনা পরিস্থিতির শিগগির উন্নতি হবে না। বন্যা পরিস্থিতি এবার দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা। অন্তত চার কোটি মানুষ বন্যা–উপদ্রুত। গ্রামের হাটবাজার ডুবে গেছে। বহু উপজেলা ও জেলা সদরে পানি। যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত। প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে, তবে তা সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
এবারের মতো পরিস্থিতি সরকারের একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি, বিত্তবান ব্যক্তি, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও, সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান—যার যতটা সাধ্য, তা নিয়েই এগিয়ে আসা কর্তব্য। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের উচিত উপমাবহুল বিবৃতি দিয়ে সরকারকে দোষারোপ না করে ত্রাণকাজে সহযোগিতা করা। বন্যায় যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই এই মুহূর্তের দাবি।
এখন আমরা বিপন্ন। কিন্তু যত দেরিতেই হোক, সুদিন আসবেই। হাটবাজার বসবে। খেলার মাঠে শিশুরা আবার কোলাহল করবে। ছেলেমেয়েরা বই–খাতা নিয়ে স্কুলে যাবে। কৃষক যাবেন মাঠে ফসল ফলাতে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ আবার হাসবে সবুজ শস্য ও শাকসবজিতে। মানবজীবনে দুঃখ-কষ্ট স্থায়ী নয়, সুখ-শান্তির স্বাভাবিক জীবনই জীবন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক