মতামত

কমিশন নয়, নির্বাচনকালীন সরকারই মূল বিষয়

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত রোববার একটি অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেছেন, তিনি সফল হয়েছেন। তাঁর এ সাফল্যের মাপকাঠি কী, সেটা তিনি নিশ্চয় একসময় আমাদের জানাবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের সামনে গত পাঁচ বছরে কমিশনের কার্যকলাপের ফিরিস্তি আছে। সেদিকে তাকালে সাফল্যের ইঙ্গিত দেখতে পাই না; উপরন্তু দেখতে পাই যে সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে তিনি এবং তাঁর সহযোগীরা কেবল ব্যর্থ হয়েছেন তা-ই নয়, দিনের ভোটকে রাতের কাজে পরিণত করছেন। তদুপরি তাঁরা এই পাঁচ বছরে গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার ব্যাপারে নাগরিকদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি করতে পেরেছেন। নির্বাচন বিষয়ে এসব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অচিরেই একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানকে শূন্য রেখে দেশ চালানো যাবে না। সংবিধানে একটি নির্বাচন কমিশন রাখার বিধান আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং ভবিষ্যতে সময়মতো নির্বাচন করা ক্ষমতাসীনদের কেবল সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনও। যেসব দেশে হাইব্রিড রেজিম বা গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মিশেলে একধরনের দো–আঁশলা ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানকার শাসকদের নির্বাচন করা খুবই জরুরি। কেননা নির্বাচনই হচ্ছে তাঁদের ক্ষমতার বৈধতা দেওয়ার উপায়। সব হাইব্রিড রেজিম এক ধরনের নয়—এ ধরনের শাসনের দুটি রূপ আছে। একটি হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ, আরেকটি হচ্ছে একচেটিয়া নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ।

সারা বিশ্বের অভিজ্ঞতা বলে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী শাসনে পুরো ব্যবস্থাটি দমন-পীড়নমূলক হলেও এবং গণমাধ্যমের ওপরে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। ক্ষমতাসীনেরা চান এ অনিশ্চয়তা দূর করতে নির্বাচনে কারচুপি করতে। তাঁরা চান প্রত্যক্ষ কারচুপি এড়িয়ে যেন নির্বাচনে জিতে আসা যায়। আর সেই লক্ষ্যে তাঁদের চেষ্টা হয় নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ওপরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। পক্ষান্তরে আধিপত্যবাদী নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনের কারচুপি এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করা হয়, যাতে প্রতিযোগিতা অকেজো হয়ে পড়ে এবং কাঠামোগতভাবেই অনিশ্চয়তা দূর হয়।

পরপর দুটি একচেটিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচনী ব্যবস্থাটি এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেকোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকলেও তা নির্বাচনী ফলাফলের ওপরে তার প্রভাব পড়বে না। নূরুল হুদা কমিশনের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে এ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বেসামরিক প্রশাসন, সরকারি দলকে একত্রে কাজ করতে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এ রূপ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের হাতে ক্ষমতার ঘাটতি ছিল না, তারা চাইলে তা ঠেকাতে পারত। কিন্তু তাদের লক্ষ্যই ছিল নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এ ধরনের রূপ দেওয়ার। এর একটি অন্যতম দিক হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। যার প্রমাণ হচ্ছে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার। এ বিবেচনায় নূরুল হুদা কমিশন আগের যেকোনো নির্বাচন কমিশনের তুলনায় নির্বাচনী ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পেরেছে। রকিবউদ্দীন কমিশন ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ পথ প্রশস্ত করেছিল, কিন্তু হুদা কমিশনের হাতেই এ অবস্থার বাস্তবায়ন হয়েছে।

বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন গঠিত হচ্ছে। সেই কমিশন বিরোধীদের আস্থা অর্জন করতে পারবে—এমন মনে করার কারণ নেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তা বলে না। নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনিভাবে ক্ষমতার অভাব নেই। কিন্তু তার প্রয়োগ করার জন্য যে দৃঢ়তার প্রয়োজন, সেটা দেখার মতো ব্যক্তিরা কমিশনের প্রধান বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন না, সেটা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের জন্য এখন দরকার নির্বাচন করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারে, এমন একটি কমিশন। সেই কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার নিশ্চয়তা বিধান করা। এ পটভূমিকাতেই দেশের ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের আয়োজন। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি করে এ আলোচনা হোক, সেটাই হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনেরা অনেকটাই সফল হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও আলোচিত হচ্ছে যে নির্বাচন কমিশন ভালো হওয়া না-হওয়ায় আদৌ কোনো লাভ হবে কি না।

সবার কাছে এটাই প্রশ্ন যে কমিশনের অধীন নির্বাচন হবে, তা কি প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন হবে, নাকি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে ধরনের ‘নির্বাচন’ হয়েছে, তারই পুনরাবৃত্তি হবে। যে কমিশন গঠন হবে, তার পক্ষে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য যা দরকার, সেই অবস্থা তৈরি হবে কি না, সেটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কেবল ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ দলগুলোর মনোনয়ন তালিকা হাতে নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি কতটা নিরপেক্ষ হতে পারবে, সেটা সহজেই বোধগম্য। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনায় যেসব বিষয় উত্থাপিত হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে কমিশন গঠনের ব্যাপারে অতীতে অভিজ্ঞতা তাঁদের আশাবাদী করে না। তাঁরা তাঁদের প্রত্যাশার কথা বলেছেন। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটি যদি তা বিবেচনায়ও নেয়, তবু ফলোদয় হবে না। কেননা তাঁদের হাতের তালিকা থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে, আর সেই তালিকার উৎস কোথায়, কীভাবে তা জানার উপায় নেই। যে বিশিষ্টজনেরা এসব পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাও এ বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত। নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব হিসেবে তাঁরা এই কথাগুলো বলছেন।

বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এ কমিশন গঠিত হচ্ছে। সেই কমিশন বিরোধীদের আস্থা অর্জন করতে পারবে—এমন মনে করার কারণ নেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তা বলে না। নির্বাচন কমিশনের কাছে আইনিভাবে ক্ষমতার অভাব নেই। কিন্তু তার প্রয়োগ করার জন্য যে দৃঢ়তার প্রয়োজন, সেটা দেখার মতো ব্যক্তিরা কমিশনের প্রধান বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন না, সেটা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধান কমিটি গঠন থেকে এ কমিটির সঙ্গে আলোচনার সময় যেটা আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে, তা হচ্ছে এসব প্রক্রিয়া তখনই অর্থবহ হবে, যখন নির্বাচনের সময় এমন সরকার থাকবে, যারা নির্বাচনকে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয় হিসেবে দেখছে না।

নির্বাচন কমিশন নিয়ে এখন যে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে এ আলোচনাই মুখ্য হওয়া দরকার যে হুদা কমিশনের হাতে নির্বাচনী ব্যবস্থার যে ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেটি আরেকটি নির্বাচন কমিশন করলেই সমাধান হবে না। সেই সমাধান করার উপায় হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আলোচনা করা। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়কে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন কমিশনের আলোচনা বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ক্ষমতাসীনেরা সেই আলোচনা করতে আগ্রহী নয়, সেটার কারণ বোধগম্য; কিন্তু বিরোধী দলগুলো সে বিষয়ে নিজেদের ভেতরে ঐকমত্য তৈরি করতে পারছে কি না, সেটাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে কোন ধরনের নির্বাচন হবে, নির্বাচন কমিশন কী ভূমিকা রাখবে।

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।