চলমান জাতিসংঘের কপ ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে, বিশ্বনেতারা তাঁদের দায় স্বীকার করেছেন এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করছেন এবারের সম্মেলনে। তাঁর উত্থাপিত চার দফা দাবি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর জলবায়ু নিপীড়িত মানুষের মনের কথাকেই তুলে ধরেছে, যার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন সারা বিশ্বে। এই সম্মেলন ঘিরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রত্যাশা, প্রাপ্তি এবং সম্ভাবনা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোধ হয় উপেক্ষিত থেকেই যাচ্ছে, যা আমাদের মতো সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির সম্মুখীন দেশগুলোর জন্য বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
প্রথমত, কার্বন নিঃসরণ পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ। পৃথিবীর সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর তালিকায় সবই উন্নত বা ব্যাপকভাবে উৎপাদনমুখী দেশগুলো; যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি। এই তালিকায় উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলোর ভূমিকা একেবারে তলানিতে। লক্ষ করতে হবে, কোনো দেশ কার্বন নিঃসরণ করলে তার কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু শুধু সেই দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। উন্নত দেশগুলোর নিঃসরিত কার্বন ও পরিবেশদূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব কিন্তু সারা পৃথিবীকেই বিপন্ন করছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলোর অবদান নগণ্য হওয়ার পরেও এই দেশগুলোকে ভোগ করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষতি।
উন্নত দেশগুলোর নিঃসরিত কার্বন ও পরিবেশদূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব কিন্তু সারা পৃথিবীকেই বিপন্ন করছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলোর অবদান নগণ্য হওয়ার পরেও এই দেশগুলোকে ভোগ করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষতি।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিদেশি বিনিয়োগ, যার প্রধান উৎসই হলো উন্নত দেশগুলো। দেখা যায়, উন্নত দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ করার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো নিজেদের দেশে পরিবেশসংক্রান্ত আইনি বিধিবিধান প্রতিপালনে কঠোর বাধ্যবাধকতা। বেশির ভাগ উন্নত দেশ নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কঠিন আইনি কাঠামো তৈরি করেছে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে বিনিয়োগকারীদের বিরাট অঙ্কের জরিমানা এবং শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। অন্যদিকে, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের অবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত; হয় ভালো আইনি কাঠামোই নেই কিংবা থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। আবার পরিবেশ নিয়ে বেশি কড়াকড়ি করলে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যেতে পারে বা নিরুৎসাহিত হওয়ার ভয়ও কাজ করে, যার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে।
গবেষকদের ভাষায় বলা যায়, বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলো ‘দূষণের স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে এই দেশগুলোতে পরিবেশের ক্ষতি (যেমন বনায়ন নির্মূল) ও দূষণ দ্রুত হারে বাড়ছে, যা দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে ত্বরান্বিত করছে।
তৃতীয়ত, যেহেতু বেশির ভাগ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় যে পরিমাণের বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার জন্য এদের বহির্বিশ্বের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বব্যাপী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য। একই সময়ে বাংলাদেশের প্রয়োজন প্রায় ১৭২ বিলিয়ন ডলারের ক্লাইমেট-স্মার্ট বিনিয়োগ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশগুলোর কাছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য প্রতিবছর কমপক্ষে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের দাবি কপ ২৬–এ উত্থাপন করেছেন। মোট চাহিদা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা বিবেচনায় নিলে নিশ্চিতভাবেই উন্নত দেশগুলোর এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ছাড় করা উচিত। অন্যথায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হুমকির মুখে পড়বে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলোতে ক্রমে বাড়তেই থাকবে।
চতুর্থত, বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত যা জলবায়ু অর্থায়ন হয়, তার প্রায় ৭৫ ভাগই ব্যয় হয় জলবায়ু পরিবর্তন রোধ কর্মকাণ্ডে (মিটিগেশন), প্রভাব মোকাবিলায় (অ্যাডাপ্টেশন) নয়। এর প্রধান দুটি কারণ হলো মিটিগেশন কর্মকাণ্ডে একধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ (যেমন: নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা কার্বন রোধের প্রযুক্তি বিক্রয়) এবং অ্যাডাপ্টেশন মূলত অভ্যন্তরীণ ব্যাপার (অর্থাৎ যে দেশের যে স্থানে ক্ষতি বা সম্ভাব্য ক্ষতি, সেখানেই কাজ করা) যাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ের সুযোগ খুব বেশি নেই। আবার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে এ অর্থ যেমন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উন্নত দেশগুলো থেকে আসে, তেমনি প্রযুক্তিও আসে সেখান থেকেই। কারণ, এই উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন মূলত উন্নত দেশগুলোতেই হয়ে থাকে।
সার্বিক বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, একদিকে উন্নত দেশগুলো নিজেদের দেশে এবং উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে কার্বন নিঃসরণে এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। অথচ নগণ্য ভূমিকা থাকার পরও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোকে এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অন্যদিকে, এ প্রভাব মোকাবিলায় যে অর্থ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন, তা নেই বেশির ভাগ উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের, যার জন্য তাদের ব্যাপকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয় সেই উন্নত দেশগুলোর ওপরেই। আবার উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এই ক্ষতিপূরণে প্রয়োজনীয় অর্থায়নে কাজ করছে একধরনের অনীহা। সব বিবেচনায় এ যেন এক জলবায়ু পরাধীনতার শৃঙ্খল। এ শৃঙ্খল ভাঙতে হলে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর নিজেদের অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের পথ যেমন খুঁজে বের করতে হবে, একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় নিজেদেরও কার্যকরভাবে সচেষ্ট হতে হবে। নতুবা কপ ২৬–এ উন্নত দেশগুলো যা–ই প্রতিশ্রুতি দিক না কেন, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যৎ সবুজ নয়, বরং কেবলই ধূসর।
ড. সুবর্ণ বড়ুয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। sbarua@du.ac.bd