কনটেইনার ডিপোর জন্য স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তানীতি দরকার

কনটেইনার ডিপোটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না বলে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড থেকে বিস্ফোরণ এমন একসময়ে ঘটেছে, যখন রানা প্লাজা বিপর্যয়ের নেতিবাচক ভাবমূর্তি কাটিয়ে বাংলাদেশের শিল্প খাত উত্তরণের পথে চলছিল। বাংলাদেশের অনেক খাতেই এখন পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার করা বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, এখানকার বেশির ভাগ নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলো প্রতিরোধযোগ্য। মালিকপক্ষ ও কর্মচারীরা কিছু সাধারণ নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। এ জন্য সবার আগে একটি স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তানীতি প্রণয়ন করতে করতে হবে।

একজন নিরীক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের কয়েকটি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো নিরীক্ষার সুযোগ আমার হয়েছে। বাংলাদেশে এখন এ ধরনের ১৯টি কনটেইনার ডিপো রয়েছে। সম্মিলিতভাবে এ ডিপোগুলো দেশের ১০০ শতাংশ রপ্তানিমুখী কার্গো এবং ২৫ শতাংশ আমদানিমুখী কার্গোর চাপ সামাল দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিপোগুলোয় একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। কনটেইনার ডিপোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক স্ট্যান্ডার্ড (আইএসও ৪৫০০১: ২০১৮) বাস্তবায়ন করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত গুটিকয় ডিপো সেটা নিশ্চিত করেছে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ আগুনের সংস্পর্শে এসে বিস্ফোরকে রূপ নিয়েছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে দাহ্য না হলেও এটি উত্তপ্ত হলে তাপীয় বিয়োজনে বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। তাই এটাকে কম তাপে সংরক্ষণ করতে হয়। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে লাগা আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায় না; বরং এতে আগুনের মাত্রা আরও বাড়ে। এ ধরনের রাসায়নিকের আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে; কিংবা ব্যবহার করতে হয় ফোম বা ড্রাই পাউডার-জাতীয় অগ্নিনির্বাপণের সামগ্রী।

বাংলাদেশে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এগুলো বিদেশে রপ্তানি হয়। সাধারণত ছোট ছোট ড্রামে ভর্তি করে ২০, ৪০ ও ৪৫ ফুটের কনটেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো রাসায়নিক বোঝাই করা হয়। বোঝাইকরণের কাজটি ডিপোতেও কিংবা কারখানাতে হয়। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রপ্তানিকারকদের উচিত, রাসায়নিক বোঝাই ড্রামগুলোয় সঠিকভাবে ট্যাগিং ও মার্কিং করা এবং পরিষ্কারভাবে রাসায়নিকের নাম লিপিবদ্ধ করা। দাহ্য ও ক্ষয়কারক হলে সে-বিষয়ক সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া। রাসায়নিকে ভর্তি ড্রামগুলো ডিপোতে স্থানান্তরের সময় প্রতিটি রাসায়নিকের এমএসডিএস (ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিট) বাধ্যতামূলকভাবে ডিপোগুলোকে হস্তান্তর করতে হবে। কেননা ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিটে প্রতিটি রাসায়নিকের বিস্তারিত তথ্য থাকে। যে ডিপো এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ, দাহ্য, দুর্ঘটনাপ্রবণ ও ক্ষয়কারক রাসায়নিক ও অন্যান্য দ্রব্য সংরক্ষণ বা কনটেইনার বোঝাই করে, তাদের উচিত সেগুলোর জন্য পৃথক হ্যাজকেম জোন (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের আলাদা এলাকা) তৈরি করা। সেখানে সর্বোচ্চ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা থেকে শুধু মুনাফা অর্জন মুখ্য বিষয় নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে তার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। এই কর্মচারীরাই একটি প্রতিষ্ঠানকে চালু রেখে মালিকপক্ষের মুনাফা অর্জনের পথ করে দেন। তাই যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আশপাশের লোকালয়ের মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন ও পরিবেশের কথাও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকে আগুন যেন না লাগে, সে জন্য ডিপো ও কারখানাগুলোয় প্রতিরোধযোগ্য অগ্নিনিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি ডিপোর নিজস্ব অগ্নিনিরাপত্তা দল থাকতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে সেটি নেভানোর জন্য নিজস্ব অগ্নিনিরাপত্তা দলকে নিয়মিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে প্রথমেই রাসায়নিকগুলোর সেফটি ডেটা শিট দিতে হবে। যাতে করে অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা সতর্কভাবে এবং সঠিক এক্সটিংগুইশার ও রাসায়নিক ব্যবহার করে আগুন নেভাতে পারেন।

বিএম ডিপোতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। বেশ কয়েকজন দগ্ধ হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, আগুনের ধরন সম্বন্ধে ফায়ার সার্ভিসকে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। আবার ডিপোর পক্ষ থেকে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে জানিয়েছে যে এটা রাসায়নিকজনিত আগুন। তবে কোথাও না কোথাও যোগাযোগ ও তথ্যঘাটতির সমস্যা এখানে ছিল।

কারাখানা হোক, ডিপো হোক, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের উচিত সেগুলোর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জনসংযোগ করা। ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ তদারকি সংস্থাগুলোকে এ সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য জানাতে হবে। তাদের অংশীজন যারা আছে, তাদেরও নিয়মিত এ তথ্য জানানোর ওপর জোর দিতে হবে। অংশীজনদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ, কর্মচারী ও কর্মকর্তা, তাঁদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্য, ভিজিটর, সরবরাহকারী এবং নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দারা রয়েছেন। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দেয়াললিখন, লিফলেট বিতরণ, প্রশিক্ষণ, অফিস নোটিশ, নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন, শিক্ষামূলক নাটিকা প্রচার—এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

বর্তমান বিশ্বে শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা থেকে শুধু মুনাফা অর্জন মুখ্য বিষয় নয়। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে তার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। এই কর্মচারীরাই একটি প্রতিষ্ঠানকে চালু রেখে মালিকপক্ষের মুনাফা অর্জনের পথ করে দেন। তাই যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আশপাশের লোকালয়ের মানুষের স্বাস্থ্য, জীবন ও পরিবেশের কথাও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে

ইফতেখার মাহমুদ স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাসংক্রান্ত পেশাজীবী এবং ব্যুরো কোয়ালিটাস সার্টিফিকেশন্স বাংলাদেশের সিইও