মতামত

কঠোর বিধিনিষেধেও থেমে নেই বালুখেকোরা

নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে।
 ফাইল ছবি

কোভিডের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এই বিধিনিষেধের সময়ে বালুখেকোদের উৎসব লেগে যায়। সম্প্রতি মুঠোফোনে খবর পেলাম, কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পয়রাডাঙা নদী (বর্তমানে বিলে পরিচিতি পেয়েছে) থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। এরপরই নাগেশ্বরী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি সেই বালু উত্তোলন বন্ধ করেছেন। রংপুর সদর উপজেলার হোসেন নগরের কাছেই ড্রেজার বসিয়ে একই স্থান থেকে কয়েক দিন ধরে বালু উত্তোলন করছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাঁরা বালু উত্তোলন বন্ধ করতে নারাজ। রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সেই বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। শালমারা নদী থেকে বালু তোলার খবর দিলে মিঠাপুকুরের ইউএনওর মাধ্যমে সেখানে বালু তোলা বন্ধ করা হয়েছে। নীলফামারীতে চেকাডারা নদী মাটি দিয়ে ভরাট করার কাজ চলছিল। ডিমলার ইউএনও সে কাজ বন্ধ করেছেন। দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলায় বালু উত্তোলন এবং একটি নদী ভরাট করার খবর পেলাম। বিরামপুরের ইউএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি নিজেই সেই স্থান দেখে এসেছেন।

মিঠাপুকুর উপজেলায় যমুনেশ্বরী-করতোয়া নদীতেও অবৈধ বালু উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। তিস্তা নদীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কয়েকটি ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে মর্মে খবর পেলাম। কুড়িগ্রামে ধরলা নদীতে নদীর শত্রুদের নামা বন্ধ করা গেলেও কঠোর বিধিনিষেধে আবার তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি একদিন রাত ১০টায় দেখলাম, ট্রাক্টরে বালু আনা হচ্ছে। তাদের কাছে জানলাম, দিনে বালু উত্তোলন করলে প্রশাসন বাধা দেয়, তাই তারা রাতে বালু উত্তোলন করছে। নদী থেকে বালু উত্তোলনের এই চিত্র শুধু রংপুরে নয়, সারা দেশে চিত্র অভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক।

নদী থেকে বালু তুললে নদীর চরম সর্বনাশ হয়। এতে নদীর গতিপথ বদলে যায়। ভাঙনপ্রবণতা ত্বরান্বিত হয়। নদীর তলদেশের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হয়। নদীর বহুবিধ যে ক্ষতি হয়, তার মূল্য দিতে হয় প্রধানত নদীপারের মানুষকে।

সরকারিভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বালু উত্তোলন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সাময়িক বন্ধ হলেও আবার একই স্থানে উত্তোলন চলতে থাকে। ড্রেজার জব্দ করার পরও বন্ধ হয় না। এক দিনে একটি ড্রেজার মেশিনে যে পরিমাণ উত্তোলন করা যায়, সেই বালুর মূল্য মেশিন এবং পাইপের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে প্রতিদিন মেশিন জব্দ করলেও তাতেও উত্তোলনকারীদের ক্ষতি নেই। মূল সমাধান হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

বালু উত্তোলন গোপনে হয় না। প্রকাশ্যেই হয়। বড় বড় গাড়িতে সেই বালু পরিবহন করা হয়। স্থানীয় ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন না। রংপুর সদরে ঘাট নদের তীরে হোসেন নগরের পাশে কয়েকজনের কথা বলে জানতে পারি, ওই নদীতে আরও অনেক স্থানে লোকাল ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা কেন প্রতিবাদ করেন না, জবাবে একজন বলছেন, ‘যাঁরা বালু তোলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারের ওপরের লোকের যোগাযোগ আছে। নিষেধ করলে হামার অসুবিধা হইবে।’ স্থানীয় ব্যক্তিদের এ অনুমান অনেকটা সত্য। ফলে সাধারণেরা এগিয়ে আসেননি। আবার এ কথাও ঠিক, তাঁরা এগিয়ে এলে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব।

নদী থেকে বালু তুললে নদীর চরম সর্বনাশ হয়। এতে নদীর গতিপথ বদলে যায়। ভাঙনপ্রবণতা ত্বরান্বিত হয়। নদীর তলদেশের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হয়। নদীর বহুবিধ যে ক্ষতি হয়, তার মূল্য দিতে হয় প্রধানত নদীপারের মানুষকে।

প্রশাসনের লোকজন এলে বালুখেকোরা সরে যায়, প্রশাসনের লোকজন সরে গেলে আবার বালু উত্তোলন শুরু হয়। এভাবে উত্তোলন বন্ধ হবে না। বরং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতে বিরক্ত হবে। এর জন্য আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই। নদীপারের লোকজনকে সচেতনও হতে হবে। নদীর দখল-দূষণ রোধ, নদী খননে অনিয়ম রোধ এবং বালু উত্তোলন বন্ধে স্থানীয় লোকজনই প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন।

বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তা, অসাধু প্রভাবশালী, অসাধু রাজনীতিক, ড্রেজারের মালিক, বালু পরিবহনকারী ট্রাক্টর কিংবা ট্রাকের মালিক, অবৈধ বালুর ক্রেতা হিসেবে ঠিকাদার কিংবা ব্যক্তিবিশেষ। গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। অবৈধভাবে উত্তোলন করা বালু যে ঠিকাদার গ্রহণ করেন, তাঁর বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ যদি নদীর বালু অবৈধভাবে তুলে নিজের কাজে লাগান, তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

প্রশাসনের লোকজন এলে বালুখেকোরা সরে যায়, প্রশাসনের লোকজন সরে গেলে আবার বালু উত্তোলন শুরু হয়। এভাবে উত্তোলন বন্ধ হবে না। বরং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতে বিরক্ত হবে। এর জন্য আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।

এ রকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হলে ড্রেজারের মালিক আর বালু উত্তোলন করবেন না, কর্মচারীরা অন্যায় কাজে আসবেন না, ট্রাক্টরের মালিক কিংবা ড্রাইভারও আর বালুসন্ত্রাসীদের সঙ্গে এ ব্যবসা করবেন না। যাঁরা বালু ক্রয় করেন, তাঁরাও সেটি করবেন না। তবে মুশকিল হলো অসাধু সরকারি কর্মকর্তা এবং নষ্ট রাজনীতিকদের নিয়ে। যেসব এলাকায় এ দুই শ্রেণির যোগসাজশ হয়, সেখানে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।

নদীর যেসব স্থানে বালু উত্তোলন চলছে, সেসব স্থানে যদি একজন করেও শাস্তি ভোগ করতেন, মামলা হতো, জরিমানা হতো, তাহলে এই বালু উত্তোলন অনেকটাই কমে আসত। ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধও হতো। এসব বন্ধ করার জন্য উপজেলা-জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার প্রয়োজন আছে।

তুহিন ওয়াদুদ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com