ভারতের গোয়ায় ব্রিকসের অষ্টম সম্মেলনটি এমন সময়ে হলো, যখন পৃথিবীর কৌশলগত ও ভূরাজনীতির কাঠামো এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছে, এ নিয়ে নানা শোরগোল হচ্ছে। আর মার্কিন নির্বাচনের প্রচারণা পর্বের শেষ মুহূর্তটি যতই এগিয়ে আসছে, ততই এটা জটিলতর হচ্ছে।
বিষয়টি হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চরম অশ্লীলতা ও লৈঙ্গিক স্থূলতা নয়, পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতেই গভীর দাগ পড়েছে। নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কে হোয়াইট হাউসের ক্ষমতায় বসবেন, সেটা বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হচ্ছে রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মর্যাদাহানি ঘটেছে। আমার পেশাগত মহলে আরও গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কথা শুনেছি, ‘আগামী বছরে যদি পারমাণবিক অস্ত্রের বোতাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে থাকে, তাহলে কি পৃথিবী নিরাপদ থাকবে?’
>রাষ্ট্রীয় মদদে সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থী মতাদর্শ, ক্ষমতার পটপরিবর্তন ও আফগানিস্তানের জঙ্গিবাদ—যেভাবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে, তাতে ব্রিকসের ভবিষ্যৎ বিবর্ণই হবে। ব্যাপারটা দুঃখজনক
গোয়া সম্মেলনটা খুবই জটিল এক কৌশলগত পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হলো, যখন মস্কো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সমর্থন দিচ্ছে—এমনকি সেখানে আইএসের ওপর বোমা হামলা করেছে, যার কারণে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে, যদিও আইএস এখনো বড় হুমকি হিসেবেই টিকে আছে। ওদিকে চীন দক্ষিণ চীন সাগরবিষয়ক ট্রাইব্যুনালের রায়ে অস্বস্তিতে রয়েছে, যেখানে তারা সংকল্প করেছে, অন্যদের চেয়ে আলাদা হবেই। ভারত নিজেও ভালো অবস্থায় নেই। উরিতে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের যে অভিজ্ঞতা হলো, তা ভালো নয়। এই চরম ক্ষতিকর তৎপরতায় পাকিস্তানের মদদ দেওয়ার ব্যাপারটা তার জন্য সুখকর নয়। আবার ওয়াশিংটন, বেইজিং ও মস্কো রাওয়ালপিন্ডির (পাকিস্তানের সামরিক সদর দপ্তর) অবস্থানের ব্যাপারে যে রকম মৌনব্রত পালন করে তাকে জায়েজ করল, তাতে তো নয়াদিল্লি হতাশ।
কথা হচ্ছে ব্রিকস একটি ব্যাংক গঠনে অনেকটা অগ্রসর হওয়ার দাবি করতে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে তা আর্থিক খাতের জন্য বড় ধরনের ব্যাপার নয়। তবে আর্থিক খাতে সারা পৃথিবীতেই যে অস্থিরতা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চয়তা হিসেবে মুদ্রার তারল্য বজায় রাখতে একমত হয়েছে—এটা একটা অর্জন। কিন্তু কথা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ হচ্ছে ১৬ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। অথচ একই সময়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৯৪ হাজার কোটি ডলার, আর তার সঙ্গে যদি জাপানের ৪ লাখ ১২ হাজার কোটি ডলারের জিডিপি যুক্ত হয়, তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ লাখ কোটি ডলার, অর্থাৎ ব্রিকসের চেয়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার কোটি ডলার বেশি। আর বর্তমানে যে তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আছে, তাতে ২০১৬ সালে এই পার্থক্য গিয়ে দাঁড়াবে ৬ লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলারে।
সন্দেহ নেই, ব্রিকস খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই চীন, ভারত, রাশিয়া একত্র হতে পেরেছে, ফলে তার নিজস্ব গুরুত্ব আছে। কিন্তু এতে আবার স্ববিরোধী ব্যাপারও রয়েছে। যেমন বলা যায়, চীন-রাশিয়া, রাশিয়া-ভারত ও ভারত-চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। আরেকটু এগিয়ে গেলে বলা যায়, এই প্রতিটি দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও কিন্তু একই রকম নয়, তাতে নানা মাত্রা আছে। তা সত্ত্বেও এই পাঁচটি দেশ বিশ্বায়নের তাগিদে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। কিন্তু তাদের এমন একটি বহু মেরুর পৃথিবীতে জায়গা করে নিতে হচ্ছে, যেখানে নানা বিপরীতমুখী চাপের মুখে দেশগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে।
ব্রিকসের একটি অস্বাভাবিক দিক হচ্ছে ২০১৬ সালে রাশিয়ার জিডিপি হবে ভারতের অর্ধেক আর চীনের ৯ ভাগের ১ ভাগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও রুশ সামরিক বাহিনী রাজনৈতিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রত্যয়ী, একই সঙ্গে শক্তিশালীও বটে। মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার আবার গণবিধ্বংসী অস্ত্রও রয়েছে।
সম্মেলন শেষ হয়ে গেছে। নেতারা একটি ঘোষণাও দিয়েছেন। এতে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু ভূরাজনীতিতে যে ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে এবং তার সঙ্গে অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো—রাষ্ট্রীয় মদদে সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থী মতাদর্শ, ক্ষমতার পটপরিবর্তন ও আফগানিস্তানের জঙ্গিবাদ—যেভাবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে, তাতে ব্রিকসের ভবিষ্যৎ বিবর্ণই হবে। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ইউরেশিয়া ডটকম থেকে নেওয়া।
সি উদয় ভাস্কর: ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক।