‘ছাড়িয়া দেশের ভুঁই, ও মোর প্রবাসী মা রে, কেমনে মরিলি তুই?’
টি এস এলিয়টের পোড়ো জমি বইয়ের কবিতাটির একটা চরণ প্রায় এ রকমই। সৌদি আরবে নির্যাতনে নিহত নাজমা বেগমের দুই শিশুপুত্রের বাবা ছিল না, এখন মা-টাও গেল। তাদের মনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা থাকলে সেই দুঃখের দহন হয়তো এমন ভাষাতেই জানতাম। মৃত্যুর দুদিন আগেও ফোন করে নাজমা অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন। শেষবার বলেছিলেন, নির্যাতন করে তাঁকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে তাঁর সৌদি ‘মালিক’। বলেছিলেন, ‘আমাকে আর বাঁচাতে পারলি না তোরা। আমাকে আর জীবিত পাইলি না।’
‘এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি’, লিখেছিলেন কবি ওমর আলী। সেই সুনাম মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত গেল। বিস্তর গৃহকর্মী লাগবে তাদের। তাই ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন ওসব দেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করলে আমরা দুয়ার খুলে দিলাম। দেশ দুটি তাদের নারীদের বাঁচাতে যা করল, আমরা তা করতে পারলাম না। পেটের যুদ্ধ বড় যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের সীমান্ত আজ মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত ছড়ানো। কেউ ঘর ছাড়ে না যদি ঘরটা হয় হাঙরের মুখ, কেউ সমুদ্রে নাও ভাসায় না, যদি ডাঙা হয় আরও বিপদের, কেউ থাই জঙ্গলে বা লিবিয়ার মরুতে মরতে যায় না, যদি দেশে বাঁচা যায়। অনেক দূরদূরান্ত থেকে তাই লাশ আসছে। যে নাকি ‘শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো...সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ,/ এক হাতে আতুর শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,/ সে তার সংসার খুবই মনেপ্রাণে পছন্দ করেছে;/ ঘরের লোকের মন্দ আশঙ্কায় সে বড় করুণ’ (শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি/ওমর আলী)। সত্যিই বড় করুণ এ দেশের নারীজীবন।
জীবন্ত মানুষ দিয়ে তাই পেলাম লাশ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে দিনে আসছে গড়ে ১১টি কফিন। আট মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও কম না। সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ২ লাখ ৬০ হাজার নারী। এই সাড়ে তিন বছরে নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিন শ। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে বলেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আত্মহত্যার এই হার তিন বছর আগের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। তার মানে এই সময়ে তাঁদের ওপর নির্যাতনও ১৭ গুণ বেড়েছে? কোনটা আত্মহত্যা আর কোনটা হত্যা, তা-ই বা কে বলবে? কোন পরিস্থিতিতে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া কোনো নারী বিদেশবিভুঁইয়ে আত্মহত্যা করেন? নির্যাতন কোন চরমে গেলে মৃত্যুই হয় সহনশীল বিকল্প! ওই সাড়ে তিন শর মধ্যে ১২০ জনের মৃত্যুর কারণ ‘স্ট্রোক’। নারীদের হৃদ্রোগের হার পুরুষের চেয়ে কম। কিন্তু মৃত্যুপুরীতে ২০-৪০ বছর বয়সী তরতাজা নারীরাও হন স্ট্রোকের সহজ শিকার।
নাজমা স্বজনদের বারবার বলেছিলেন, বাড়ি বিক্রি করে হলেও তাঁকে যেন বাঁচানো হয়। এই দেশে মানুষের চেয়ে বাড়ি অনেক মূল্যবান বিধায়, তাঁকে ফেরত আনার খরচ মেটানো যায়নি। সন্তানের জন্য জীবন দিতে পারেন মা। কিন্তু বিদেশির বান্দি যে, যৌন নিপীড়িত হতে হতে তার করুণ মৃত্যুতে কিসের সান্ত্বনা? দেশে মরলে খাটিয়া পেতেন, বিদেশে মরায় কফিন পেয়েছেন, বিমানে চড়ে ফিরতে পেরেছেন। এটুকু বটেই উন্নতি। কিন্তু এটাই কি প্রবাসী শ্রমিকের ভবিতব্য? মধ্যপ্রাচ্যে তাঁদেরও কি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো রাষ্ট্রহীন ভাবা হয়? ভেবে তেমন আচরণই কি করা হয়? ২০১৪ সালের আগের ছয় বছরে এসেছে ১৪ হাজার কফিন। উন্নয়নে গর্বিত রাষ্ট্রের টনক কি তারপর নড়ার কথা ছিল না?
নাজমা বেগম কোনো ব্যতিক্রম নন। অনলাইন জগতে সৌদিতে আটকে পড়া অজস্র নির্যাতিত বাংলাদেশি নারীর আহাজারি দেখা যায়। গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন, অঝোর কান্নায় ভেসে যাওয়া সেসব মুখের নারীরা একটা কথাই বলে যান বারবার, ‘আমাকে বাঁচাও, আমাকে ফেরাও’। এই আকুতি কেবল পরিবারের প্রতি না। তাঁরা তাঁদের সরকারকে ডাকেন, দূতাবাসকে ডাকেন। তাঁরা তাঁদের দেশকে ডাকেন, যেই দেশের ভোগবিলাসের প্রধান ভরসা এসব প্রবাসী নারীর পাঠানো রেমিট্যান্স। টাকা নাকি কথা বলে, কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো টাকার ভোক্তা যাঁরা, তাঁরা নীরব। বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে প্রবাসী শ্রমিকেরা অভিযোগ জানাতে গেলে অপমানিত হন, অনেক সময় মারও খান। আমাদের জাতীয় লাঞ্ছনার দৈর্ঘ্য কেবলই বাড়ে।
ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে বদরাগী স্বৈরশাসক। কিন্তু এক ফিলিপিনো গৃহকর্মীকে হত্যা করে এক মাস লাশ ফ্রিজে রেখে দেওয়ার সচিত্র খবর প্রকাশ পেলে দুতার্তে এক বৈঠকেই কুয়েতে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করেন। অথচ নির্যাতনে নিহত নাজমা বেগমের লাশ এক মাস পড়ে থাকল সৌদি মর্গে; আমরা সয়ে নিলাম। আমাদের প্রবাসী আয় দরকার, কিন্তু যেসব মানুষ এই আয় করেন তাঁদের প্রতি রইলাম নিদায়। তাঁদের কর্মজীবন নিরাপদ করার জন্য চেষ্টাচরিত্র করব না, ২ নম্বরি আদম ব্যবসায়ীদের দমাব না—এটাই কি ওই নীরবতার সিদ্ধান্ত?
সবই কর্মফল। গত সপ্তাহের শেষে ঢাকায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ইত্যাদি বাড়ানোর আন্দোলনে পুলিশ লাঠিপেটা করল। নাজমার বাঁচার আকুতিতে সাড়া না দেওয়া আর প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দাবি ও মর্যাদাকে পেটানোর ব্যবস্থা এক সুতাতেই গাঁথা। যদি আপনি শিক্ষায় আরও খরচ না করেন, তাহলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে না। শিশুরা বয়সকালে নর-নারী হয়ে উঠবে ঠিকই কিন্তু যোগ্যতায় থাকবে প্রাণীর চেয়ে সামান্য ওপরে; অন্য সবার পেছনে। দেশের ভেতরে হলে তাদের পোশাক কারখানা কিংবা জাহাজভাঙার মতো কাজে আর বিদেশে হলে আরব ধনকুবেরদের বিকৃত বাসনার ভোগে পাঠিয়ে মুদ্রা কামানো যাবে—যদি তাঁরা নারী হন। যেটুকু শিক্ষিত করলে একজন বিদেশে নিজেকে বাঁচাতে পারেন, ফোন করতে পারেন যথাযথ জায়গায় বা বেছে নিতে পারেন উন্নত বিকল্প, মানসম্পন্ন সেটুকু শিক্ষা আমরা দিচ্ছি না। যে শিক্ষকদের পেটাচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের আমরা ওসব দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিষেবা ইত্যাদিতে পাঠাতে পারতাম।
যেসব দেশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষার কদর করে, তাঁদের মর্যাদা ও সুযোগ দেয়, সেসব দেশের মানুষ বিদেশে দাসের জীবন কাটান না, অকাতরে মরেন না। যেসব দেশ শিক্ষক পেটায়, সেসব দেশ কীভাবে প্রবাসে তার নাগরিকের জীবন রক্ষাকে গুরুতর দায়িত্ব মনে করবে, তা মাথায় আসে না।
ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
faruk.wasif@prothomalo.com