‘বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে ৩৬ ঘা!’ এই কথা লোকে বলে।
‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ!’ এই কথা বলেছিলেন জনৈক পুলিশ বাহাদুর, গত জানুয়ারিতে এক কাকডাকা ভোরে, সিটি করপোরেশনের একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাকে ছিনতাইকারী ভেবে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারতে মারতে।
আমার টেবিলে দুই-তিন মাস ধরে থানা থেকে পাঠানো একটা ফরম রাখা আছে। সেটার নিচে অবশ্য বাণী দেখছি: ‘পুলিশ আপনার বন্ধু, নিরাপত্তার যেকোনো প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নিন।’
কিন্তু আমি নিতান্ত ছা-পোষা অবলা নারী। মাথার ওপর পুরুষ অভিভাবক নেই। সারা দিন কর্ম করে খাই। পুলিশ বাহাদুরদের একটু তফাতে রেখে চলতে পারলে নিরাপদ বোধ করি।
‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ার’-এর কথায় গেলাম না। র্যাব ভাইদের নাম নিতেও আমার বুক কাঁপে। পুলিশি প্রতাপেরই যা সব ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ঘটনার কথা ইদানীং ঘন ঘন কাগজে পড়ছি! এমনিতে এ জীবনে পুলিশের সঙ্গে দুই-চারবার ঠোকাঠুকি যা হয়েছে, খুব একটা সুখকর হয়নি।
মনে পড়ে, একবার বাড়ির কাছের রাস্তায় এক পুলিশ ভাই আমাকে মাথায় কাপড় দিয়ে চলতে হুকুম করেছিলেন ‘শুক্রবার দিন। মহিলা মানুষ মাথায় কাপড় দেন।’
....কর্মসূত্রে এ দেশের অনেক ‘খারাপ পাড়ায়’ ঘোরা হয়েছে। সেসব জায়গায় শরীর বেচা মেয়েদের কাছে আইনের রক্ষকদের নানা কীর্তিকলাপের কথা শুনেছি। কিছু নিজের চোখেও দেখেছি।
এই মেয়েরা দেখেছি সবচেয়ে ভয় পান পাড়াঘেঁষা থানা বা ফাঁড়ির পুলিশকে। এঁরা এই মেয়েদের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব আর ঠিকুজি কুষ্ঠি জানেন। সেসব তথ্যের জোরে ভয়ভীতি দেখিয়ে এঁরা এসব মেয়েকে দোহন-শোষণ-পীড়ন করেন, পয়সাপাতি কামান; কখনো তথ্যগুলো প্রকাশ করে মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনের অকিঞ্চিৎকর শান্তি-স্বস্তি আর আড়ালটুকু তছনছ করে দেন।
পেশার সুবাদে যাঁরা আমার ভাইবেরাদর, এ লেখায় তাঁদের প্রসঙ্গে যাব না। এ লেখাটা পুলিশ ভাইদের নিয়ে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, আমার টেবিলে সযত্নে রাখা থানার ওই ফরমটি নিয়ে।
সম্ভবত গত নভেম্বর মাসে বিভিন্ন থানা রাজধানীবাসী নাগরিকদের কাছে এ ফরম পাঠানো শুরু করেছিল। আমার কাছে আসা ফরমটির শিরোনাম: ‘বাড়ি/ফ্ল্যাট মালিকের তথ্যাবলি’। রাজধানীর ‘ভাড়াটে’দের জন্যও এমন ফরম গেছে।
এই ফরমে পুলিশ জানতে চেয়েছে: আমার নাম (ছবিসহ); পিতার নাম; জন্মতারিখ; বৈবাহিক অবস্থা; বাড়ির ধরন (বিস্তারিত বিবরণসহ); বর্তমান ঠিকানা; স্থায়ী ঠিকানা; ধর্ম; পেশা ও প্রতিষ্ঠান/কর্মস্থলের নাম-ঠিকানা; শিক্ষাগত যোগ্যতা; মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল আইডি; জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর; পাসপোর্ট নম্বর (যদি থাকে); জরুরি যোগাযোগ (নাম-সম্পর্ক-ঠিকানা-মোবাইলের নম্বর); এবং গৃহকর্মী, ড্রাইভার ও নিরাপত্তারক্ষীর নাম (ছবিসহ), স্থায়ী ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর।
কোনো সৌজন্যের বালাই নেই। ফরমটির সঙ্গে কোনো অনুরোধ বা ব্যাখ্যার চিঠি পাইনি। মনে হতে পারত, পুলিশ কোনো গোপন জরিপ করতে নেমেছে। তবে পত্রিকা পড়ে জানতে পারি, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর উদ্দেশ্যে এসব তথ্য সংগ্রহ করছে। সেটা কী রকম?
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ডিএমপি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, তারা বিভিন্ন থানার এলাকায় ‘বিট পুলিশিং’ কার্যক্রম শুরু করেছে। ডিএমপির কমিশনার মহোদয় তখন বলেন, বিভিন্ন অপরাধী ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ঢাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভুয়া নাম-ঠিকানা-কাগজপত্র নিয়ে অথবা কোনো নাম-ঠিকানা না দিয়ে বিনা চুক্তিতে বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে। তাই বিট পুলিশিংয়ের আওতায় তাঁরা ঢাকার বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের সম্পর্কে ‘পরিচিতিমূলক’ তথ্য জোগাড়ে নেমেছেন।
>ও ভাই পুলিশ, ‘সুনাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব’ পালন করতে মনটা সায় দিচ্ছে না যে! সরষেতেই ভূত—এসব কথা মনে আসছে
কমিশনার আরও বলেছিলেন, অপরাধের তথ্য দিতে এবং অপরাধ প্রতিরোধের জন্য পুলিশকে সাহায্য করতে জনগণ আইনত বাধ্য। তা ছাড়া, ‘পুলিশিং কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান একজন সুনাগরিকের সামাজিক দায়িত্বও বটে।’
অতএব ফরমটি দ্রুত পূরণ করে থানায় জমা দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে মালিক ও ভাড়াটের জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্ট অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট। ভাড়াটে চলে গেলে তক্ষুনি থানাকে জানাতে হবে। নতুন ভাড়াটে এলে নতুন করে ফরম ভরতে হবে। এসব ‘অনুরোধ’ জানিয়ে কমিশনার বলেন, তথ্যগুলো দিয়ে ডিএমপি একটি ডেটাবেইস বানাবে।
ভালো রে ভালো! যুদ্ধাহত লক্ষ্মণকে বাঁচানোর জন্য হনুমান বিশল্যকরণী লতা আনতে পাহাড়ে গিয়েছিলেন। লতাটি চিনতেন না, তাই বীর হনুমান পুরো গন্ধমাদন পর্বতই মাথায় করে নিয়ে এলেন! পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহাদুরেরা সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের সুনির্দিষ্ট কোনো হদিস পাচ্ছেন না। তাই রাজধানীর সব বাড়িওয়ালা-ভাড়াটেকে সন্দেহের আওতায় এনে তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো থানায় থানায় জড়ো করা হবে!
আর কী সব তথ্য! ফরমগুলো থাকবে কোথায়, কার হেফাজতে? ডেটাবেইস কীভাবে, কোন আইনে করা হবে? তথ্যগুলো গোপন রাখার কী ব্যবস্থা পুলিশ নিচ্ছে?
আমার মুঠোফোনের নম্বর আর ই-মেইল ও যোগাযোগের ঠিকানা যে যার-তার হাতে গিয়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কী? এমনিতেই পণ্যবিক্রেতাদের উটকো ফোন আর বার্তার উৎপাতে অস্থির আছি। ফরমের তথ্যের মোচড় দিয়ে কোনো পুলিশ ভাই বা তাঁর পরম বন্ধু কোনো ‘সোর্স’ যে আমার ব্যক্তিগত নিভৃতি ও নিরাপত্তা তছনছ করবেন না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? ‘গোপন সূত্রে’ তথ্যগুলো কোনো অপরাধী চক্রের হাতে গিয়ে পড়ার আশঙ্কাও তো উড়িয়ে দিতে পারছি না!
তা ছাড়া, সন্ত্রাসী-জঙ্গি খোঁজার সঙ্গে আমার জন্মতারিখ, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, শিক্ষাগত যোগ্যতা—এসব একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যের কী সম্পর্ক?
যত দূর জানি, ব্যক্তিগত জীবনযাপনে নির্বিঘ্নতা, নিভৃতি ও স্বাধীনতা অথবা ব্যক্তিগত তথ্যে ও জীবনে গোপনীয়তার সুরক্ষা আমার সাংবিধানিক অধিকার। ‘প্রাইভেসি’ শব্দটি ঠিক না বললেও সংবিধান আমার এই অধিকার নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ বৃহত্তর জনস্বার্থের পোক্ত যুক্তি এবং আইনি ভিত্তি ছাড়া পুলিশ এটা ক্ষুণ্ন করতে পারে না।
পুলিশ এসব তথ্য চেয়েছে ডিএমপি অধ্যাদেশের বিধিমালার ৪ (খ) ধারা অনুসারে। সেখানে আছে, ঢাকা মহানগর এলাকায় জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নকারী যেকোনো উদ্যোগ ঠেকানোসহ শান্তি বজায় রাখতে ডিএমপির কমিশনার ‘দ্রুত যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।’
এই ‘ফরম ও ডেটাবেইস’-এর ঢালাও অভিযানকে ঠিক নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে নেওয়া ‘দ্রুত পদক্ষেপ’ বলা যায় কি না, তা বুঝতে পারছি না। এত ‘যেকোনো’ দেখলে মন এমনিতেই ভড়কে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ৩ মার্চ একজন ভাড়াটে হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে এই অভিযান বন্ধ করার জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। তাঁর আরও আবেদন ছিল, পুলিশ যেন ইতিমধ্যে সংগৃহীত তথ্যগুলো কোনো কাজে ব্যবহার না করে। এ ছাড়া, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত এগুলো গোপনে সংরক্ষণ করে।
হাইকোর্ট অবশ্য ১৩ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। অ্যাডভোকেট বড়ুয়া ফোনে বললেন, খারিজের আদেশের অনুলিপি হাতে পেলে আপিল করবেন।
এদিকে থানা বলেছিল, ১৫ মার্চের মধ্যে ফরমটি পূরণ করে দিতে হবে। এখন তা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ও ভাই পুলিশ, ‘সুনাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব’ পালন করতে মনটা সায় দিচ্ছে না যে! সরষেতেই ভূত—এসব কথা মনে আসছে।
কুররাতুল-আইন-তাহমিনা: সাংবাদিক।