রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু হলে তা কীভাবে সবাইকে জানানো হবে, বছর দু-এক আগে গার্ডিয়ান পত্রিকায় তার বিস্তারিত বিবরণ বেরোলে বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। পাঠক-শ্রোতারা টেরও পান না যে নামীদামি ব্যক্তিদের মৃত্যুর অনেক আগেই সাংবাদিকেরা তাঁদের জন্য শোকগাথা তৈরি করে রাখেন। শুধু মৃত্যুদূতের আগমনের অপেক্ষা। এরপর দেখা যায় মুহূর্তের মধ্যেই সেই গুণীজনের নানা ধরনের অর্জন বা সাফল্য, পাওয়া না-পাওয়া, দুঃখ-আনন্দের বিভিন্ন বিবরণের একটা সংকলিত রূপ প্রকাশ করা হয়। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। কেননা, কোনো রাজনৈতিক দলের মৃত্যু এক দিনে ঘটে না। ধীরে ধীরে তা হয়তো অন্য কোনো দলে বিলীন হয়, নয়তো কয়েক দশক বা প্রজন্ম ধরে ধুঁকতে থাকে।
অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। রাষ্ট্র যদি কোনো দলকে বেআইনি ঘোষণা করে, তাহলে তার বিলোপ ঘটতে পারে। তবে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞায় বিলোপ ঘটলেও সেই দলের পুনরুজ্জীবন যে অসম্ভব নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসই তার প্রমাণ। ১৯৭৫-এ বিলুপ্ত হওয়া দলগুলো আবার ১৯৭৮ সালের পর একে একে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং নানা ধরনের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকাংশই টিকে আছে। রাজনৈতিক দলের আগাম মৃত্যুসংবাদ লেখার বিষয়টি অবশ্য বাংলাদেশে ঠিকই ঘটছে। ২০১৪-১৫-তে কিছুদিন এ রকম লেখা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হয়েছে, যেগুলোতে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কটের কারণে দলটির অকালমৃত্যু ঘটবে। তাঁরাই আবার ২০১৮ সালে লিখলেন ডিসেম্বরের নির্বাচনে দলটি অংশ না নিলে তার আর অস্তিত্ব থাকবে না। রাতের বেলায় ভোটবাক্স ভর্তির প্রতিযোগিতায় ভরাডুবির শিকার হওয়ার পর এখন আবার দলটির মৃত্যুর সংবাদ (অবিচুয়ারি) প্রকাশের হিড়িক পড়েছে।
বিএনপির বিলুপ্তিতে দেশে একমুখী রাজনীতি একধরনের স্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং তা জাতির উন্নয়নযাত্রাকে রেশমের মতো মসৃণ করে দেবে, এমন আশাবাদই এ ক্ষেত্রে প্রবল। গণতন্ত্রের অকালপ্রয়াণ কিংবা রাজনীতিশূন্যতায় তাঁদের কোনো উদ্বেগ নেই, দুঃখিত হওয়ারও কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি প্রহসনের কারণে ভোটকেন্দ্রগুলো যে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে, নির্বাচন যে শুধু ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়েছে, সেই সংকট প্রশ্নে কোনো বিকার নেই। অথচ নির্বাচনের নামে খরচ হচ্ছে করদাতাদের শত শত কোটি টাকা।
বিএনপির বিকল্প হিসেবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক শক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবির্ভাব ঘটেনি। অথচ ভিন্নমত ছাড়া কোনো সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে না। ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সমঝোতায় টিকে থাকা কোনো দলকে বিরোধী দল মনোনীত করলেই সেই কাঙ্ক্ষিত বিকল্প সৃষ্টি হয় না। দেশ পরিচালনায় এখন রাজনীতির স্থান কোথায়? রাজনীতিকদের ভূমিকাই বা কী? দেশের কোন দলটি সংকটে নেই? এমনকি, সরকারের পছন্দের বিরোধী দলেও নেতৃত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে চলছে তোলপাড়। ১০ বছর জোটবদ্ধ হয়ে ছিল যেসব ক্ষুদ্র শরিক, এবার মন্ত্রিসভায় জায়গা না পেয়ে তাদের মধ্যেও চলছে টানাপোড়েন। সংরক্ষিত নারী আসনে পারিবারিক মনোনয়ন নিয়ে একটি দলে মান-অভিমানের পালা যেন থামছেই না। আরেকটি দল তো নির্বাচনের আগেই দ্বিখণ্ডিত হয়েছে এবং একটি ভাগে একজন পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগেও যে রাজনীতি রমরমা, দলটির প্রবীণ রাজনীতিকদের নিস্পৃহতা-নিষ্ক্রিয়তায় এমন আলামত মেলে না। মন্ত্রিত্ব না থাকায় দলটির ঝানু রাজনীতিকদের এখন সময় কাটে হয় নাতি-পুতিদের সঙ্গ দিয়ে, নয়তো স্মৃতিকথামূলক কলাম লিখে। দলটির ঘোষণাপত্রে একসময় ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে রক্ষণশীল এবং গোঁড়া ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো খোলামেলাই বলে থাকে যে বর্তমান সরকারের চেয়ে ধর্মবান্ধব সরকার তারা এর আগে পায়নি। শোষণমুক্ত সমাজের অঙ্গীকারের বিপরীতে অর্থনীতিতে বৈষম্য এখন সর্বোচ্চ।
ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি—এ দুটোর সঙ্গেই একসময় বিএনপির নামটা আপনা-আপনি চলে আসত। এরশাদও সেই ধারাই অনুসরণ করেছেন। এখন আওয়ামী লীগ এই ধারা অনুসরণে সবাইকে যে শুধু ছাড়িয়ে গেছে তা-ই নয়, বরং তারা নিজেদের অবস্থান বেশ সংহত করে ফেলেছে। ব্যাংক-বিমার উদ্যোক্তা পরিচালক কিংবা পোশাক রপ্তানিকারকদের মতো পুঁজিপতি-শিল্পপতিরা এতটা বাজারবান্ধব সরকার আর পায়নি। আবার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে ভিন্নমত দমনে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে, তারও কোনো জুড়ি নেই। এসব ক্ষেত্রেও উন্নয়নের মতোই নতুন নতুন নজির তৈরি হচ্ছে।
রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে দেওয়ার কথা কে বলেছিলেন সেই প্রশ্নটা যদি না-ও করি, তবু নির্দ্বিধায় বলা যায় বিষয়টা এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। ডান-বাম-মধ্যপন্থী কারও হাতেই নেই। সরকার পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযোগিতা ক্রমেই কমছে। মূলত প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোই এখন সরকারের প্রতিভূ। ফলে স্বভাবজাত ঋণখেলাপিদের ঋণে ছাড় দেওয়া কিংবা আমলাদের বিনা সুদে গাড়ি-বাড়ির ঋণ দেওয়া যে অগ্রাধিকারের বিষয় হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের সাংসদেরা যে সরকারের করুণায় সংসদে এসেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নাজমুল হুদার মতো সুপরিচিত রাজনীতিকদের দিয়ে সরকারবান্ধব বিএনপি গড়া সম্ভব হয়নি বলেই হয়তো এসব প্রায় অচেনা কয়েকজন নেতার কপাল খুলেছে। বলা হচ্ছে, সরকারবান্ধব বিএনপির আবির্ভাব ঠেকাতে বাধ্য হয়েই তাঁদের শপথ গ্রহণকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দলের মহাসচিবের আসন হারানো সেই জোড়াতালির পরিণতি। সংসদ নির্বাচনে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে—এমন ধারণার পর দলটি ইত্যবসরে বর্জন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচন। চরম দুর্দিনেও উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন মাঠপর্যায়ের শতাধিক নেতা।
গণফোরাম লাভবান হলেও দলটির নেতৃত্ব বদল এবং রাজনীতির জোড়াতালি দলটিকে সংহত করার বদলে অস্থিরতা বাড়াবে তাতে সন্দেহ নেই। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এসেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকীও কথা এবং কাজের অসংগতির ব্যাখ্যা চেয়ে সময় বেঁধে দিয়েছেন। বিএনপির পুরোনো সঙ্গীরাও অস্থিরতায় ভুগছেন। বিএনপির সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ যে জামায়াতে ইসলামী, সেই দলেও ভাঙন ধরেছে। সংস্কারপন্থীরা নতুন দল গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে পুরোনো জামায়াতের মূল নেতা গত সপ্তাহেই নীরবে লন্ডন ঘুরে এসেছেন। তাঁর এই বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাওয়াকে ব্রিটেনের বাংলা সাপ্তাহিক সুরমা যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী বলে অভিহিত করেছে।
ব্যতিক্রম শুধুই বাম জোট। ওই জোটের কেউ জোট ছাড়ারও হুমকি দেয়নি বা কোনো দলের নেতৃত্বেও কোনো রদবদল ঘটেনি। হতে পারে, এই জোটের অবস্থান এতটাই প্রান্তিক যে জাতীয় রাজনীতির এত বড় বিপর্যয় তাদের খুব একটা নাড়া দেয় না এবং সে কারণে তাদের মধ্যে এসব নিয়ে বিতর্কের খুব একটা অবকাশ নেই। আবার এমনও হতে পারে যে আদর্শিক অবস্থানে অনড় থাকার কারণেই তাঁরা বিপর্যয়ের ধাক্কা থেকে দলকে রক্ষা করতে পেরেছেন।
নির্বাচন নিয়ে যত অস্বস্তিই থাক, বিদেশিরা সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে ছেদ টানেনি। তবে তারা ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীও একই কথা বলছে। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ের ভিন্নমত আর গণমাধ্যম রাজনৈতিকশূন্যতা পূরণের ক্ষমতা রাখে না। গণমাধ্যম এখন যে দৈন্যদশায় নিপতিত হয়েছে, তাতে তাদের কাছে এ রকম ভূমিকা প্রত্যাশা করা অবাস্তব। নির্বাচনোত্তর রাজনীতির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় জায়গা না পাওয়ার সাম্প্রতিকতম নজিরগুলো এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। ভোটের অধিকারকে নির্বাচনব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে আনার মতো বিষয়ে ন্যূনতম কর্মসূচিতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছাড়া এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের অন্য কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিকে নিয়ে যাঁরা শোকবার্তা লিখছেন, তাঁরা অবশ্য কোনো বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক