‘ওরফে সন্ত্রাসী’ লিখে গুগল করতেই ল্যাপটপের পর্দায় গুলিবৃষ্টির মতো ঝেঁপে এল হাজারটা খবরের লিংক। সেগুলোতে ইঁদুর ঠুকে ঠুকে ওরফের মালায় গাঁথা অনেকগুলো খেতাবি নামের নাগাল পেলাম। খেতাবগুলো বিচিত্র: গালকাটা, গলাকাটা, কালা, ধলা, ফাটা, নাটা, কানা…।
খবরগুলো কিন্তু মর্মান্তিক: ‘সন্ত্রাসী’ ছাপ্পামারা মহাজন এই ব্যক্তিরা কাউকে মেরেছেন, নিজেরা মারা পড়েছেন, ধরা পড়েছেন, পালিয়ে গেছেন, ভারত-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-দুবাইয়ে ঘাঁটি গেড়ে নামের দামামা বাজিয়ে দেশের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’ ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। পুলিশ শীর্ষ ‘সন্ত্রাসী’দের নামের তালিকা করছে। অথবা করছে না। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানটি সাইজে থান ইটের মতো। সেখানে সন্ত্রাসী শব্দের অর্থ: ‘নির্যাতন হত্যা প্রভৃতির দ্বারা সমাজে ত্রাস সৃষ্টিকারী’। শব্দটি বিশেষণ। আমার চেতনায় অবশ্য ‘সন্ত্রাসী’রা মূর্তিমান কীর্তিমান জলজ্যান্ত একেকটি বিশেষ্য। সন্ত্রাসবাদী শব্দটির আবার আলাদা মাজেজা, আলাদা ঝাঁজ।
যাক। আমার বিদ্যা অল্প। শব্দের প্যাঁচে না জড়ানোই নিরাপদ। এমনিতেই বিষয়টা ভয়ংকর আর সময়টা খারাপ। এ লেখায় বরং এ যুগের সন্ত্রাসী মহাজনদের ওরফেযুক্ত নামগুলো নিয়ে কিছু বাচালতা করি।
বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে জনৈক বাবুলের নাকি একদিকের গাল উড়ে গিয়েছিল। তাঁর নাম হয়ে গেল ‘সাইড-অফ বাবুল’। সন্ত্রাসী জগতে কয়েকজন বাবুল ছিল, তকমা পেয়ে তিনি ওয়ান অ্যান্ড ওনলি হলেন। এটা অবশ্য নিছক গালগল্প। বাস্তবে ওরফেযুক্ত একাধিক গালকাটা, গলাকাটা, পেটকাটা আছেন। আছেন কিলার, টাইগার, পাগলা, ডাকাত, বোমারু বা গ্রেনেড খেতাবধারীরা। নামেই তাঁদের কীর্তির পরিচয়।
যে রিপোর্টাররা অপরাধজগতের খবর লেখেন, সহকর্মীরা তাঁদের আদর করে ‘ক্রিমিনাল’ বলে ডাকেন। পেশাবন্ধু ক্রিমিনালদের শরণাপন্ন হয়ে সন্ত্রাসীদের নামের দশকওয়ারি তালিকা পেলাম। আর পেলাম কিছু গল্প।
যুগে যুগে অনেকগুলো ওরফে-নাম হয়েছে শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে খোঁটা দিয়ে। ঘোরতর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’, কিন্তু নাম কমন পড়লে শনাক্তকরণে অব্যর্থ। ঠোঁটকাটা, কালা, ধলা, কানা, পিচ্চি, ন্যাটা, নাটকা, মোটা, ভোটা, বাঁটকু, লম্বু, শুঁইটকা, ল্যাংড়া—এসব তাই একাধিক জনের নামের ভূষণ। এক নামের দুজনের একজন খেতাব পেলেন ‘ব্ল্যাক’, অন্যজন হলেন ‘হোয়াইট’। হোয়াইট যে জন, তাঁর চোখের মণি সাদাটে। ছিলেন এক নাদুসনুদুস ‘গদা’। এক্সেল বাইক চালাতেন, তাই একজনের নামে জুড়ে গেল ‘এক্সেল’। দুই নামের দুজন হলেন ‘ফাটা’, শীতকালে তাঁদের গা আর পা ফাটত।
‘মুরগি’ উড়ে এসে বসেছিল দুই জমানার দুজনের নামের আগে, যাঁদের একজনের বাবা ছিলেন মুরগিবিক্রেতা। পিতার ব্যবসার সুবাদে একজনের খেতাব বদলে হলো ‘ডিলার’। নিজেদের ব্যবসার সুবাদে দুজনের নাম ‘বালতি’ আর ‘ডিশ’-এর টোপর পরল। ‘ফ্রিডম’ খেতাবধারীরা ফ্রিডম পার্টি করতেন। কুকুর নিয়ে যিনি ঘুরতেন, তাঁর নামের নিশান ‘ডগ’।
বাংলা মদে চুর হয়ে থাকতেন যিনি, তাঁর খেতাব জুটেছিল ‘বাংলা’। পর্নো চ্যানেলে আসক্তির সুবাদে একজনের নামের ভূষণ ‘টিভি সিক্স’। আরেকজনের ‘সেঞ্চুরি’ তকমায় শত ধর্ষণের বাহাদুরি। সুইডেন আসলামের নামে ইউরোপবাসের সুবাস। ‘টোকাই’ আর ‘এতিম’ তকমায় বঞ্চিত শিশুকালের ছায়া। খেতাবের তালিকায় আরও আছে ভাঙাড়ি, কাঙালি, মাউরা, জাউরা, বাস্টার্ড ওরফে বি.। ‘মরা’, ‘গিট্টু’ আর ‘ফিঙে’র মর্মার্থ কে বা জানে।
দু-চারজন নারীর খেতাবও স্মরণযোগ্য। যেমন ‘ব্যাংক’—ব্যাংক ডাকাতিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ‘মাফিয়া চুরনি’ ওরফে ‘ফুলন’—মাদক ব্যবসায় দাপটের স্বীকৃতি। আরেক ‘ফুলন’ নাম করেছিলেন খুন আর ডাকাতিতে। পকেটমার দলনেত্রীর ‘মুখপুড়ি’ খেতাবটি অবশ্য অন্য সন্ত্রাসীদের দেওয়া আগুনে পোড়ার চিহ্ন।
বাবা-মায়েরা কত আশা-ভরসা-স্বপ্ন নিয়ে সন্তানের ‘ভালো নাম’ দেন। এঁদের এগুলো হলো নিজের উপার্জিত ‘কালো নাম’। সেভেন-স্টার বাহিনী, তিন ভাই বাহিনী, দাদাবাহিনী, মামা-ভাগনে বাহিনী—এমন বেশ কিছু সন্ত্রাসী দলের নাম নাকি সাংবাদিকদের দেওয়া। আর মহাজনদের নামকরণে নাকি পুলিশেরও ভূমিকা থাকে।
ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা গুলিতে নিহত হওয়ার ২৮ দিন পর পুলিশ বলেছিল, হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। হত্যাকারী সন্দেহে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তিনজনের নাম দেখুন: মো. রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগনে রাসেল ওরফে কালা রাসেল এবং তামজিদ আহম্মেদ ওরফে রুবেল ওরফে মোবাইল রুবেল ওরফে শুটার রুবেল। ডিএমপির কমিশনার বলেছিলেন, নেপথ্যে থাকা অনিশ্চিতনামা এক ‘বড় ভাই’কে খোঁজা হচ্ছে। (প্রথম আলো, ২৭. ১০.২০১৫)
কারা ‘বড় ভাই’, তাঁরা কোথায় বা ঘাপটি মেরে থাকেন, কে তা জানতে পারে! কিন্তু আমি ভাবছি চাক্কি কী করে বিদ্যুৎ হলো আর মোবাইল কীভাবে শুটারে গড়াল। ভাগনে রাসেল হয়তো কালা রাসেল হয়েছিলেন তাঁর গায়ের রঙের বদৌলতে। কিন্তু তেমনটা না-ও হতে পারে। জাঁদরেল সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর নাকি ‘কালা’ হয়েছিলেন কালা ধান্দায় জড়ানোর সৌজন্যে।
২০১০ সালে পুরান ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তা গৌতম রায় খুন হন। হত্যাকারী সন্দেহে পুলিশ আর র্যাব তিনটি নাম বলে: হায়দার, জাকির ও মানিক। পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে, র্যাব করে দুজনকে। দুই বাহিনীই বলে, তারা হায়দারকে ধরেছে। র্যাব পাকড়াও করেছিল জনৈক আহমেদ হায়দারকে। কিন্তু পরিবার ও মহল্লার লোকজন বলেন, তিনি সন্ত্রাসী নন; খুনের সময় তিনি বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। এদিকে পুলিশ তাদের ধরা লোকটির নাম বলে আহমেদ আলী ওরফে হায়দার ওরফে হাদী। সব দেখেশুনে প্রথম আলো খবরটির শিরোনাম করে: ‘পুলিশের হায়দার, হায়দার না; র্যাবের হায়দার সন্ত্রাসী না’। (প্রথম আলো, ২৮.০৪.২০১০)
নামে ওরফের গিঁট পড়ার এক বেয়াড়া ব্যাখ্যা দিলেন একজন ক্রাইম রিপোর্টার। উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরুন, হালাকু খানকে ধরতে গিয়ে আইনের রক্ষকেরা ধরলেন খালাকু খানকে। খাতায় তাঁর নাম উঠল: খালাকু ওরফে হালাকু খান। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তারা সাব্যস্ত করলেন, আসলে দায়ী চেঙ্গিস খান। তখন খাতায় নামটি দাঁড়াল খালাকু ওরফে হালাকু ওরফে চেঙ্গিস খান। তারপর স্থির হলো, না রে, এটা কুবলাই খানের কীর্তি। সুতরাং লাগাও ওরফে, যোগ করো কুবলাই খান। আরও পরে থুক্কু দিয়ে বলা হলো, নাহ্, কুকীর্তির নায়কটি আতিলা হুন বাবাজি। কুছ পরোয়া নেহি, ওরফে তো আছে! হায় রে বেচারা খালাকু খান!
শিশুকালে লেজ দিয়ে যায় চেনা বইটা খুব প্রিয় ছিল। এখন দেখছি, নাম দিয়ে যায় মানুষ চেনা—যাঁর নাম তাঁকে এবং যিনি নাম দেন, তাঁকেও। ওরফেনামার মধ্যে একটা ট্র্যাজেডি কি দেখতে পাচ্ছি?
‘কচি-সংসদ’ রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের এক অবিস্মরণীয় গল্প। কচি-সংসদের সেক্রেটারি পেলব রায়ের পিতৃদত্ত নাম ছিল পেলারাম: ‘বিএ পাস করিয়া ছোকরার কচি এবং মোলায়েম হইবার বাসনা হইল। সে গোঁফ কামাইল, চুল বাড়াইল এবং লেডি-টাইপিস্টের খোঁপার মতন মাথার দুপাশ ফাঁপাইয়া দিল। তারপর মুগার পাঞ্জাবি, গরদের চাদর, সবুজ নাগরা ও লাল ফাউন্টেন পেন পরিয়া মধুপুর গিয়া আশু মুখুজ্যেকে ধরিল—ইউনিভার্সিটির খাতাপত্রে পেলারাম রায় কাটিয়া যেন পেলব রায় করা হয়। স্যার আশুতোষ এক ভলুম এনসাইক্লোপিডিয়া লইয়া তাড়া করিলেন।’
কচি-সংসদের অন্য সদস্যদের নাম ছিল শিহরণ সেন, বিগলিত ব্যানার্জি, অকিঞ্চিৎ কর, হুতাশ হালদার, দোদুল দে এবং লালিমা পাল (পুং)—‘লালিমা পাল মেয়ে নয়। নাম শুনিয়া অনেকে ভুল করে, সে জন্য সে আজকাল নামের পর “পুং” লিখিয়া থাকে।’
নামের আছর পড়ে কাজে, নাকি কাজের আছর পড়ে নামে? এতক্ষণ যাঁদের নামের ওরফে ঘাঁটলাম, তাঁরা কি কালো নাম কাটিয়ে ভালো নাম নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন? অভিজ্ঞ অপরাধ-সাংবাদিক পারভেজ খান বলছিলেন, ‘সন্ত্রাসীদের চুল পাকে না।’ তার আগেই নাকি তাঁরা গুম হন অথবা খুন হন। তিনি আরও বললেন, আগে সন্ত্রাসীরা পরম্পরা মান্য করতেন। তাঁদের আদব–লেহাজ ছিল, নেতৃত্বের গুণ ছিল। তাঁরা পুলিশকে তোয়াজ করতেন না। কিন্তু এখন দিনকাল পাল্টে গেছে।
একটা ধাঁধা বলি: আমি থাকি জলে, তুমি থাকো ডালে; তোমায় আমায় দেখা হয় মরণের কালে। উত্তরটা হচ্ছে মাছ আর মরিচ। মরণের কালে আগুনের জ্বালে দুই জগতের দুই বাসিন্দার মহামিলন ঘটে। এই পর্যায়ে মাথার মধ্যে ‘সেঞ্চুরি’, ‘হাজারি’, ‘ক্রসফায়ারি’, ‘বন্দুকযুদ্ধ খিলাড়ি’—এমন কতগুলো শব্দ ওরফের আশপাশে বসে যেতে চাইছে।
নাহ্। বেমক্কা ঠাট্টা-ফাজলামি থামানো দরকার। দেরিতে জ্বলি, বন্ধুদের দেওয়া একটা ওরফেনাম আমারও আছে: ‘টিউবলাইট’। আমার মনে এখন ভয় জাগছে।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা : সাংবাদিক।