বড় রাস্তার মাঝখানে ঘেরা জায়গা, সেখানে আকাশছোঁয়া যন্ত্রপাতি। ঢাকা শহরের অনেক জায়গার এটি একটি পরিচিত দৃশ্য। বলছি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কথা। যদি সেই নির্মাণাধীন এলাকার আশপাশে পদচারী–সেতু থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। চলার পথে প্রায়ই দেখা যায়, পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে নির্মাণকাজ। তা দেখবে নাই-বা কেন? এমন কাজ তো এ দেশে আগে হয়নি।
আমাদের শহরে মেট্রোরেল আসছে—এ বড়ই স্বস্তির বিষয়। মেট্রোরেলে নাকি অকল্পনীয় কম সময়ে চলে যাওয়া যাবে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথায়। থাকবে না যানজট। জটজর্জর এই শহরের সাধারণ নাগরিকদের জন্য এর চেয়ে সুখের কথা আর কী হতে পারে! মেট্রোরেল তো যাবে মাথার ওপর দিয়ে, কিন্তু নিচের রাস্তার অবস্থা কী হবে? প্রশ্নটি আরও খোঁচাচ্ছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। সম্প্রতি রাজধানীর যানজট নিরসনে পৃথক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঘোষণা অনুযায়ী গাবতলী থেকে আজিমপুর (মিরপুর রোড), সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ ও কুড়িল থেকে খিলগাঁও হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত সড়কে এখন থেকে আর রিকশা চলবে না। এ নিয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ রিকশাচালকেরা। তাঁরা গত মঙ্গলবার অবরোধ-বিক্ষোভও করেছেন।
যেকোনো বিষয়েই আমরা দ্বিধাবিভক্ত থাকি। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, রিকশা বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁরা বিপদে পড়েছেন। আবার কেউ বলছেন, পুরো ঢাকা শহর থেকেই রিকশা তুলে দেওয়া উচিত। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ‘হাঁটার অভ্যাস’ তৈরির উপদেশ। বলা হচ্ছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতেই রিকশা চলাচল বন্ধের এই পদক্ষেপ। তা ভালো। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরুক, তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য রিকশা আসলে কতটুকু দায়ী?
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আসলে প্রধান সড়কে রিকশায় চড়ার পর যখন পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বাস চলে, তখন বেশ ভয় করে। মনে হয়, এই বুঝি চাপা দিল। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করে। সেই বিবেচনায় প্রধান সড়কে বাসের ফাঁকে ফাঁকে রিকশা চলা যে ঝুঁকিপূর্ণ, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এই প্রসঙ্গে একদিনের কথা বলি। আজিমপুর থেকে যাচ্ছিলাম শান্তিনগর। দোয়েল চত্বর আসতেই আমার রিকশা ঘুরিয়ে দেওয়া হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশের রাস্তায়। যদিও চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিছু রিকশা ও গাড়িকে আটকানো হলো না। চলে গেল আমার জন্য ‘নিষিদ্ধ’ পথেই। কিন্তু কার্জন হলের রাস্তাতেও লাভ হলো না, কিছু দূর গিয়েই দেখি রাস্তা বাঁশ দিয়ে আটকানো। রিকশাচালক রিকশা ঘুরিয়ে গেলেন শাহবাগের দিকে। সেখানে মোড়ে নেমে এক ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম হুট করে দোয়েল চত্বরে আটকে দেওয়ার হেতু। তিনি সাফ জানালেন, যান নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি করতে হয়। আমাকে বললেন শাহবাগ মোড় থেকে বাসে করে যেতে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য দাঁড়ানোর বেশ কিছুক্ষণ পর বাস এল, তবে তাতে এত যাত্রীর ভিড়ে নিজের রোগাপটকা শরীর নিয়ে ওঠার সাহস হলো না। আবার খুঁজলাম রিকশা। চালক এবার ভাড়ায় আকাশ ছুঁতে চাইলেন, আমি তাঁকে জমিনে নামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। অগত্যা আমার মানিব্যাগ যথেষ্ট পরিমাণে হালকা হয়ে আমার মন ভারী করে দিল।
এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বয়ানের কারণ আছে। ঢাকা শহরে প্রায় সময়ই বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর সঠিক কারণও জানা যায় না। যদি সেই রাস্তায় রিকশার চলাচল বন্ধ করাই হবে, তবে মাঝেমধ্যে চালু করা কেন? ভেবেচিন্তে একটি নিয়ম তৈরি করা হলে তা ভাঙার দরকার কী? যদি ওই রাস্তায় রিকশা চালানোয় সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে একেবারে বন্ধ করে দিলেই হয়। সে ক্ষেত্রে যাত্রীদের জানাবোঝাও স্পষ্ট থাকে, ফলে ‘শাশ্বত’ আইন ভাঙতে তারা উৎসাহীও হবে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষই যদি নিয়মের বরখেলাপ করে, তখন?
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। প্রতিদিন একই রাস্তা দিয়ে আমাকে কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। একটি নির্দিষ্ট মোড়ের পর রিকশা যাওয়া মানা। কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে হাত মেলালেই সেই নিষেধাজ্ঞা কর্পূরের মতো উবে যায়। কতবার দূর থেকে দেখলাম—দুই বাঁ-হাত মিলে গেল আর তিন চাকার মানবচালিত যানও সুন্দর চলে গেল প্রধান সড়কে। এর সমাধান কী হবে? নিয়ম তৈরি করলেন যাঁরা, তাঁরাই যদি এভাবে তা ভঙ্গ করেন, তখন সাধারণ নাগরিকদের সামনে কী দৃষ্টান্ত তৈরি হয়? আদতে এভাবেই সৃষ্টি হয় আইন ভাঙার প্রবণতা।
ঢাকা শহরে যানজটের অন্যতম একটি কারণ রিকশা, তবে তা প্রধানতম নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ। অথচ ঢাকায় এই পরিমাণ মাত্র ৭-৮ শতাংশ। এর একটি বড় অংশ আবার পার্কিং ও হকারদের দখলে। সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা যে নাগরিকদের হাঁটার অভ্যাস করতে বলছেন, তা হাঁটবে কোথায়? ফুটপাতে দোকান আছে, গাড়িও দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। সব এড়িয়ে তা–ও হয়তো হাঁটার চেষ্টা করা গেল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর এমনভাবে পেছন থেকে মোটরসাইকেল হর্ন বাজায়, মনে হয় ফুটপাত বোধ হয় তাদের জন্যই! হাঁটা পথের পথিকই সেখানে অপাঙ্ক্তেয়। এই বাস্তবতায় হাঁটার অভ্যাস তৈরি করার উপদেশ শুনলে গা জ্বালা করে। ভোগান্তি তো নিচ্ছিই, আবার ন্যাড়া মাথায় বেল ভাঙার দরকার কী?
ট্রাফিক বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে যে পরিমাণ রাস্তা আছে, তাতে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ি চলছে। লাইসেন্স ছাড়াই চলছে লাখ লাখ রিকশা। তা এই মাত্রা ছাড়ানো সংখ্যার যানবাহনের নিবন্ধন দিল কে? নিবন্ধনবিহীন রিকশা তুলে দেওয়া হচ্ছে না কেন? আরও আছে। ঢাকার যানজট থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সেখানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক বলেছিলেন, ঢাকায় চলাচলকারী মানুষের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। অথচ এই গাড়িগুলো সড়কের ৮০ শতাংশ জায়গা ব্যবহার করে। অন্যদিকে ঢাকার ৭৫ শতাংশ মানুষ চলাচল করে বাসে, যা মোট সড়কের ২০ ভাগের কম জায়গা ব্যবহার করে। এই চিত্র বদলানো নিয়ে কিন্তু খুব একটা কথা শোনা যায় না। অন্যদিকে এই শহরের রাস্তায় অনেক যাত্রীর হাত-পা, এমনকি জীবন গেছে, কিন্তু লক্কড়ঝক্কড় বাস চলা কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি।
আসলে ঢাকা শহরে যানজটের সমস্যার কারণ অনেক গভীরে। সেগুলোর কোনোটার সমাধান না করে শুধু চটজলদি ও চটকদার কিছু সিদ্ধান্তেই কি রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে? প্রয়োজনে পুরো শহরেই রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হোক। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থাটি তো থাকতে হবে। তা না করে এক সিদ্ধান্তেই কি ঢাকা সিঙ্গাপুর হবে? প্রশ্ন আরও আছে। রিকশা চলাচল বন্ধ করায় যে রিকশাচালকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির মতো সময় কি তাঁদের দেওয়া হচ্ছে? শ্রেণির হিসাবে রিকশাচালকেরা নিম্নবিত্তের। ৫০–১০০ টাকার হেরফেরে কিন্তু তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হতে পারে। সেদিকটা একেবারে উপেক্ষা করে তাঁদের ‘গ্রামে গিয়ে ধান কাটার’ পরামর্শ দেওয়াটা উপহাসের মতো শোনায়। এই ঢাকা শহরে আমি-আপনি যে প্রলোভনে এসেছি, ওই রিকশাচালকেরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তা হলো বেশি আয়, বেশি সুযোগ-সুবিধা। নিজেরটা পূরণ হলেই তো আর অন্যের পথে বাধা সৃষ্টির অধিকার জন্মায় না।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার। রিকশার ভাড়া পাবলিক বাসের চেয়ে বেশি, আবার সিএনজি বা অ্যাপভিত্তিক গাড়ির চেয়ে কম। চিত্রটি সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে নির্দেশ করে। তারা হলো মধ্যবিত্ত। তারা সাধ্য অনুযায়ী সাধকে বশে আনার নিরন্তর চেষ্টা করে যায়। সেই জায়গায় যখন রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে, তখন কমপক্ষে কিছু বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা না হলে মধ্যবিত্ত মানুষ দিশেহারা বোধ করে। যেমনটা বাজারে ঢুকলেই ইদানীং আমাদের হয়। অবশ্য কারও বিত্তের শ্রেণি বদলে গেলে ভিন্নকথা। তখন কিছুদিন আগের কাঙ্ক্ষিত বস্তুই অপছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়ে।
এ দেশে প্রশ্ন অনেক, উত্তর কম। উত্তর দেওয়ার প্রতি এখন আগ্রহও বোধ হয় কমে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের ভাবনারও কোনো কারণ নেই আসলে। কারণ এ দেশে ‘ন্যাড়া মাথার’ অনেক নাগরিক আছে। তাদের মাথায় যখন-তখন বেল ভাঙা যায়। বাংলা প্রবাদে আছে, ন্যাড়া বারবার বেলতলায় যায় না। কথাটি এই জনপদে খাটে না। এখানে ন্যাড়াকে বেলতলায় বেঁধে রেখে মাথায় বেল ভাঙা হয়। সত্যজিৎ রায়ের একটি বিখ্যাত ছবির সংলাপে বলা চলে, ‘তাতে কি আর এসে গেল!’
অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
arnab.sanyal@prothomalo.com