রবীন্দ্রনাথের ‘রাজপথের কথা’ ছোটগল্পে রাজপথ বলছে, ‘আমি রাজপথ। অহল্যা যেমন মুনির শাপে পাষাণ হইয়া পড়িয়া ছিল, আমিও যেন তেমনি কাহার শাপে চিরনিদ্রিত সুদীর্ঘ অজগর সর্পের ন্যায় অরণ্যপর্বতের মধ্য দিয়া, বৃক্ষশ্রেণীর ছায়া দিয়া, সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরের বক্ষের উপর
দিয়া দেশদেশান্তর বেষ্টন করিয়া বহুদিন ধরিয়া জড়শয়নে শয়ান রহিয়াছি।’
রবিঠাকুরের রাজপথের কপাল ভালো, সে ঢাকা শহরে ঢোকেনি। যদি ঢুকত, তাহলে তার ‘চিরনিদ্রিত সুদীর্ঘ অজগর সর্পের ন্যায়’ ‘জড়শয়নে শয়ান’ থাকা বেরিয়ে যেত। কারণ, ঢাকা শহরের পথ হলো এমন একটি ‘জনস্থান’, যেখানে যার যা ইচ্ছা তা-ই কার্যত অবাধে করা চলে। ঘটি থেকে বাটি, মলম থেকে কলম, ধামা থেকে জামা—সব কেনাবেচার জায়গা হলো এখানকার রাজপথ। মিছিল থেকে অবরোধ, পথসভা থেকে জনসভা, মানববন্ধন থেকে অনশন ধর্মঘট—এসব আয়োজনেরও আদর্শ জায়গা হলো রাজপথ।
সিগারেটের প্যাকেটে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ থাকার পরও যেমন ধূমপায়ী সিগারেট ছাড়ে না, তেমনি সিটি করপোরেশন বা প্রশাসন তিন বেলা ‘সতর্ক’ করলেও ‘পথসেবীরা’ পথ থেকে সরে না। পৈতৃক সম্পত্তিজ্ঞানে রাজপথ আঁকড়ে থাকে তারা।
শুধু কি পথ? পথের ওপর যে উড়ালপথ কিংবা পদচারী-সেতু, তার ওপরও সুবিন্যস্তভাবে হাটবাজার বসে। লোকজনের হাটবাজারে যাওয়ার কষ্ট লাঘবের কথা মাথায় রেখে এসব দোকানপাট বসা নিয়ে আগেও বিস্ময়ের তেমন কিছু ছিল না। এখনো নেই। পথ যেহেতু ‘জনস্থান’, সেহেতু জনতার একাংশ বিচিত্র আবদারে সেখানে বাজার বসাতে পারে—এই যুক্তি আমরা মেনে নিয়েছি।
কিছুদিন আগে মতিঝিল, গুলিস্তান, নিউমার্কেটসহ বেশ কিছু এলাকায় সিটি করপোরেশন মহা হম্বিতম্বি করে সংকেত দিয়েছিল, পরিবর্তন এসে গেছে। সিটি করপোরেশনের পাইক-পেয়াদা খুব ধমকটমক দিয়ে সব পথ একেবারে ‘সোজা’ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। মহাসমারোহে উচ্ছেদ অভিযানও শুরু হয়েছিল। পথ দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা লোকজনের পথে বসার উপক্রম হয়েছিল। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তখন তাঁরা মারমুখী হয়েছিলেন। তাঁরা মিছিল–সমাবেশও করেছিলেন। সুখের কথা, ওই সময় দুই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা এই অন্যায় আবদারটি রক্ষা করেননি। তখন সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ফুটপাত এবং পথের ওপর দোকানদারি চলতে পারে না। বার্তাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উচ্ছেদকাজ বেশ কিছুদিন কার্যকরও ছিল। কিন্তু পথ নিয়ে এই রাজধানীতে ক্রমাগত যে কুনাট্যটি মঞ্চস্থ হয়, তা আবারও শুরু হয়েছে। আবার দোকানপাট পথবর্তী হয়ে পড়েছে।
অতি আমোদের বিষয় হলো এই কুনাট্যের গভীরে আছে একটি বিচিত্র যুক্তি। অধিকারের যুক্তি। প্রথমে কেউ কোনো একটি পছন্দমাফিক স্থান দখল করে পথের কোনো এক জায়গায় বসে পড়েন। অতঃপর সেই স্থানের ওপরে নাকি তাঁর একধরনের অধিকার জন্ম লাভ করে। সম্পূর্ণ অনধিকার থেকে এই দখলকার্যের উৎপত্তি এবং বিকাশ। একসময় তা ‘অধিকার’ হয়ে দাঁড়ায়। এই অধিকারের নাম ‘দখলসূত্রের অধিকার’। এই ‘অধিকার’ নিয়েও ‘অধিকারীদের’ নিজেদের মধ্যে বিবাদ বাধে। সেই বিবাদ নিষ্পত্তির দুটি পরিচিত পথ আছে। প্রথম পথটি ‘পার্টি অফিস’ ঘুরে যায়। দ্বিতীয় পথটি সরাসরি ‘বাহুবলীদের’ হাতে। তবে রাজনীতি এবং বাহুবলের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের বলে স্বভাবতই পথ দুটি দুই দিকে বেঁকে যায়নি।
ঢাকার রাজপথের অবস্থা দেখলে মনে হতেই পারে, আইন-আদালত বলে কিছু নেই। গায়ের জোর অথবা বন্দুকের নলই যাবতীয় ক্ষমতার উৎস। এই অবস্থা এক দিনে হয়নি। অকারণেও হয়নি। যাঁরা পথ দখল করেন, তাঁদের জন্য পার্টি অফিস আছে, থানা-পুলিশ আছে, বাহুবলীরাও আছেন। এই ফুটপাত দখলকারীদের অধিকারবোধ এতটাই দৃঢ় ও সংহত যে তাঁদের উচ্ছেদ করতে গেলে তাঁরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের, এমনকি আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দিতেও ছাড়েন না। ফলে ব্যস্ত রাস্তাঘাটজুড়ে বসে পড়াকেও যে অধিকার বলে মেনে নেওয়া যায়, তা আমরা বারবার প্রমাণ করে আসছি।
পুরানা পল্টনে ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের ব্যবসা করেন এমন এক ভদ্রলোক সেদিন বলছিলেন, তিনি ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। ‘পজিশন’ (পজেশন) বিক্রি করে দেবেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের পজিশন?’ জানালেন, তিনি ফুটপাতের যে জায়গাটুকু দখল করে ব্যবসা করেন, সেটুকু হচ্ছে ‘পজিশন’। এই ‘পজিশন’ তিনি অনেক বছর আগে ২০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। মাসে মাসে দোকান ভাড়ার মতো তাঁকেও ভাড়া দিতে হয়। এখন পজেশন ছাড়বেন। পাশের এক ব্যবসায়ী ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন। তিনি লাখ টাকার নিচে ছাড়বেন না। তিনি মাসে মাসে কাকে ‘ভাড়া’ দেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি আধ্যাত্মিক গুরুদের মতো একটা স্মিত হাসি দিলেন। বললেন, ‘যিনি নেবার তিনিই নেন রে ভাই!’
সুশাসন ঠিক কী পরিমাণ অসহায় হলে এমন আজব কাণ্ড সহজে সম্ভব, তা এ দেশের পণ্ডিতদের বুঝতে কষ্ট হলেও জনসাধারণ কিন্তু হাড়ে–মজ্জায় বুঝতে পারছে।
পুরানা পল্টনের এই ঘটনা একটি দৃষ্টান্তমাত্র। এমন দখল-বেদখলের নজির দেশজুড়ে বিস্তৃত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণেই তার কোনো প্রতিকার হয় না—এটা সবাই জানে। কিন্তু কেউ তা স্বীকার করতে চান না।
আপনি ফুটপাত বা রাস্তা দখলের সঙ্গে কারা কারা সংশ্লিষ্ট, তা অনুসন্ধান করতে নেমে দেখুন। প্রথমে দেখবেন একজন যদু অথবা মধুকে। সেই যদু-মধু কার খুঁটির জোরে রাস্তা দখল করল, তা খুঁজতে গিয়ে পাবেন রাম অথবা শামকে। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে একজন ‘ভাশুর’ পাওয়া যাবে। সেই ভাশুরের নাম তখন আপনি বা আমি কেউই মুখে আনতে পারব না। এর কারণ হলো সেই ভাশুর ‘রাজনীতি’ নামক একটি দুর্গে বাস করেন। সেই দুর্গ এমনই দুর্ভেদ্য যে তা ভেদ করতে পারার সাধ্য কোনো আইন–আদালতের নেই।
সুশাসন যে রাজনৈতিক করতালির বিনিময়ে আসতে পারে না, নির্বাচনী লাভালাভের স্বার্থে যে প্রশাসনিক বুদ্ধিকে বিসর্জন দেওয়া সংগত নয়, তা ভাশুরদের মাথায় সহজে ঢোকে না। অথচ এই বিষয়টি দেশের ‘স্বভাব-যুযুধান’ রাজনৈতিক শিবিরগুলো যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল। তাতে জনতার লাভ। দেশেরও।
সারফুদ্দিন আহমেদ, প্রথম আলোর জে্যষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com